শিশুদের ভিটামিন এ এর অভাবজনিত রোগ এবং ভিটামিন এ এর উৎস
শিশুদের ভিটামিন এ এর অভাবজনিত রোগের ভয়াবহতা বিবেচনা করেই সরকারী উদ্যোগে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর বয়সভেদে বিভিন্ন ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। এটি প্রাণীদেহের শারীরিক বৃদ্ধি ও বিকাশ এবং শরীরবৃত্তীয় বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করে। তবে ভিটামিন এ অতিরিক্ত খেলে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকা প্রণয়ণের সময় পরিমিত পরিমাণ ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার রাখা উচিত।
ভিটামিন এ মানবদেহের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে শিশুদের জন্য এই উপাদানটি অত্যাবশ্যকীয়। তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ভিটামিন এ জাতীয় খাবারের পাশাপাশি ভিটামিন এ এর অভাবজনিত রোগ এবং তা প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে জানা জরুরী যা পর্যায়ক্রমে আলোচিত হয়েছে।
ভূমিকা
ভিটামিন এ হলো চর্বিতে দ্রবণীয় শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। ইহা দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক রাখতে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিশুদের জন্য ভিটামিন এ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শরীরকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন এ দিতে ব্যর্থ হলে এর অভাবজনিতে কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অনুরূপভাবে অতিরিক্ত ভিটামিন এ গ্রহণ করলেও কিছু সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। তবে শিশুদের ভিটামিন এ এর অভাবজনিত রোগগুলো বেশি চোখে পড়ে। তাই ছোট-বড় সকলের জন্য সবদিক বিবেচনায় রেখে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ভিটামিন এ জাতীয় খাবার রাখা উচিত।
ভিটামিন এ এর উৎস
রঙিন ফলমূল, সবুজ শাক-সবজি ও কিছু প্রাণীজ উৎস থেকে ভিটামিন এ পাওয়া যায়। মূলত দুটি উৎস থেকে ভিটামিন এ এর উৎপত্তি:
- উদ্ভিজ উৎস
- প্রাণীজ উৎস
আরও পড়ুন: ভিটামিন বি জাতীয় খাবারের প্রাকৃতিক উৎস
উপরের দুটি উৎস থেকেই দুটি ভিন্ন ভিন্ন রূপে ভিটামিন এ পাওয়া যায়। রূপ দুটি হলো: প্রি-ফর্মড ভিটামিন এ এবং প্রো-ভিটামিন এ। প্রি-ফর্মড ভিটামিন এ গুলো মাছ, মাংস, মুরগি, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যসহ প্রাণীজ উৎসগুলোতে পাওয়া যায়। অন্যদিকে প্রো-ভিটামিন এ পাওয়া যায় উদ্ভিজ উৎস থেকে।
ভিটামিন এ জাতীয় ফলের নাম
- আম
- জাম্বুরা
- পাকা পেঁপে
- আনারস
- কাঁঠাল
- সফেদা
উল্লেখিত ফলগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, উক্ত ফলগুলোতে পুষ্টির অন্যান্য উপাদানও বিদ্যমান।
ভিটামিন এ জাতীয় সবজির নাম
- গাজর
- পালং শাক
- টমেটো
- মিষ্টি আলু
- কুমড়া
- ব্রকলি
- লেটুস পাতা
- ক্যাপসিকাম
- বাঁধাকপি
- লাল মরিচ
- সবুজ শাক-সবজি ইত্যাদি
ভিটামিন এ এর দৈনিক চাহিদার একটা বিরাট অংশ এ সবজিগুলো থেকেই আসে। ভিটামিন এ এর পাশপাশি অন্যান্য পুষ্টি উপাদানও এই সবজিগুলোতে পাাওয়া যায়।
প্রাণীজ উৎস থেকে প্রাপ্ত ভিটামিন এ
- গরুর কলিজা
- মুরগীর কলিজা
- মাংস
- ছোট মাছ (মলা ও ঢেলা মাছ)
- দুধ
- পনির
- মাখন
- ঘি
- ডিমের কুসুম
- স্যামন মাছ
- কড লিভার অয়েল
- মাছের তেল ইত্যাদি
ভিটামিন এ এর পাশাপাশি আরও অনেক পুষ্টিগুণ আছে এই খাবারগুলোতে।
ভিটামিন এ সবচেয়ে বেশি থাকে কোনটিতে?
সাধারণত অত্যধিক গাঢ় রংঙের শাক-সবজি ও ফলমূলে ভিটামিন এ এর পরিমাণ বেশি থাকে। এর মধ্যে-
- গাজর
- মিষ্টি কুমড়া
- মিষ্টি আলু
- পালংশাক
- ব্রকোলি
- আম
- পাকা পেঁপে ভিটামিন এ এর জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ভিটামিন এ জাতীয় খাবার খেলে কি হয়?
পুষ্টি উপাদানের মধ্যে ভিটামিন এ এর ভূমিকা অনন্য। প্রাণীদেহের শারীরিক গঠন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে এই উপাদানটির উপকারিতা অপরিসীম। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য অনুযায়ী একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের দৈনিক ৯০০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন এ গ্রহণ করা উচিত এবং একজন নারীর প্রয়োজন ৭০০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন এ। ভিটামিন এ এর অভাবজনিত রোগ প্রতিরোধে ভিটামিন এ জাতীয় খাবারের উপকারিতা সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো:
- রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
- কোষের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক রাখতে সহযোগিতা করে।
- ত্বকের ফ্যাকাসে ভাব দূর করে এবং ত্বককে প্রাণবন্ত রাখে।
- প্রজনন ক্ষমতা সক্রিয় রাখে।
- ক্যান্সারের মত কঠিন রোগের ঝুঁকি হ্রাস করে।
- হাড়ের ক্ষয় রোধ করে এবং হাড়কে মজবুত করে।
- দাঁত ও অস্থির স্বাভাবিক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
- মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ভিটামিন এ এর অভাবজনিত রোগ
ভিটামিন এ একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান। দেহে দীর্ঘদিন ভিটামিন এ এর ঘাটতি থাকলে নিম্নোক্ত সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে:
- ভিটামিন এ এর অভাবজনিত রোগগুলোর মধ্যে রাতকানা রোগে সবচেয়ে বেশি মানুষ ভোগে। এ রোগের রোগীরা দিনের বেলায় দেখতে কোনো সমস্যা না হলেও রাতের বেলা তাদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হতে থাকে এবং দেখতে অসুবিধা হয়। কখনও কখনও দীর্ঘদিন এ রোগে ভোগলে এবং সঠিক চিকিৎসা না পেলে চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারাতে পারে।
- ভিটামিন এ এর অভাবে দেহে রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে পারে।
- দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে ব্যাগাত ঘটে।
- দীর্ঘদিন ভিটামিন এ এর অভাব ধীরে ধীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নিস্ক্রিয় করে ফেলে।
- ত্বক শুষ্ক হয়ে যায় এবং ত্বকের উজ্জলতা নষ্ট হয়ে যায়।
- টিউমার ও বিভিন্ন ধরনের চর্ম রোগ হতে পারে এবং তা ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে।
- ভিটামিন এ এর অভাবে স্তন ক্যান্সার হতে পারে।
- ভ্রুনের সমস্যা দেখা দেয় এবং প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পায়।
- চুল রুক্ষ হয়ে যায় এবং চুল পড়া বৃদ্ধি পায়।
- কখনও কখনও ভিটামিন এ এর অভাবে শ্বাস-কষ্টের সমস্যা হয়ে থাকে।
- ভিটামিন এ এর অভাবে অল্প বয়সে মুখে বলি রেখা পড়ে এবং চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ পড়ে যায় ।
- হাত ও পায়ের নখ ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।
শিশুদের ভিটামিন এ এর অভাবজনিত রোগ
পৃথিবীতে বছরে প্রায় ৬,০০,০০০ শিশু ভিটামিন এ এর অভাবজনিত সমস্যায় ভোগে। বিশেষ করে ৪ বছরের নিচের শিশুরা ভিটামিন এ এর অপুষ্টির শিকার। এজন্য পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ দেশে বিনামূল্যে শিশুদের ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। শিশুদের ভিটামিন এ এর অভাবজনিত রোগগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রোগ ও উপসর্গগুলো নিম্নরূপ:
আরও পড়ুন: ভিটামিন বি এর অভাবজনিত রোগ
- শিশুদেহে ভিটামিন এ এর অভাব হলে শিশুর চোখের মণির আবরণী কোষ নষ্ট হয়ে তার উপর সাদা আস্তর পড়ে এবং এক পর্যায়ে চোখ নষ্ট হয়ে যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এ রোগকে বলে কেরাটোম্যালেশিয়া।
- দীর্ঘদিন ভিটামিন এ এর অভাবে শিশুর চোখের কর্ণিয়ায় আলসারের সৃষ্টি হয় যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় জেরফথ্যালমিয়া বলে।
- শিশুর চোখের কর্ণিয়ার শিরা শুকিয়ে যেতে পারে।
- শিশুদেহে ভিটামিনে এ এর ঘাটতির ফলে হাম ও ডায়রিয়াজনিত বিভিন্ন রোগ হতে পারে।
- ভিটামিন এ এর অভাবে শিশু দেহের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটে।
- শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং জ্বর, সর্দি ও কাশির মত রোগগুলো লেগেই থাকে।
শিশুদের ভিটামিন এ এর অভাবজনিত রোগের প্রতিকার
আমরা দৈনিক যে খাবার খাই সাধারণত সেসব খাবার দিয়েই ভিটামিন এ এর অভাব পূরণ হয়ে যায়। তবুও ভিটামিন এ এর অভাবে কোনো সমস্যা দেখা দিলে নিম্নোক্ত উপায়ে তা প্রতিকার করা সম্ভব।
- নিয়মিত পরিমিত পরিমাণ ভিটামিন এ সমৃদ্ধ শাক-সবজি ও ফলমূল খেতে হবে।
- ভিটামিন এ এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নিজ শিশুর অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে।
- জন্মের পরপর শিশুকে মায়ের বুকের শাল দুধ খাওয়াতে হবে।
- শিশুকে নিয়মমাফিক সরকার প্রদত্ত ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইনের ক্যাপসুলগুলো সেবন করাতে হবে।
- কোনো পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী ডায়েট অনুসরণ করা যেতে পারে।
- সর্বোপরি ভিটামিন এ এর অভাবজনিত যেকোনো উপসর্গ পরিলক্ষিত হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন এ এর বিভিন্ন ওষুধ গ্রহণ করা যেতে পারে।
ভিটামিন এ অতিরিক্ত খেলে কি কি সমস্যা হতে পারে?
মাত্রাতিরিক্ত কোনো কিছুই মঙ্গলজনক নয়। আমাদের খাদ্য তালিকায় হরেক পদের খাবার থাকে এবং সেগুলোর মধ্যে বিভিন্ন রকম খাদ্য উপাদান বিদ্যমান। তার একটিও যদি আমরা মাত্রাতিরিক্ত সেবন করি তাহলে তা আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। ভিটামিন এ অতিরিক্ত খেলে নিম্নোক্তো সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে।
- মানবদেহ মাত্রাতিরিক্ত ভিটামিন এ গ্রহণ করলে বমি বমি ভাব হওয়া কিংবা বমি হওয়া, মাথা ঝিমঝিম করা, মাথা ব্যাথা করা, ডায়রিয়া ও ডায়রিয়া জনিত বিভিন্ন রোগ হতে পারে।
- অতিরিক্ত ভিটামিন এ গ্রহণ করলে এবং দীর্ঘদিন শরীরে জমা থাকলে লিভার ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
- এছাড়াও অতিরিক্ত ভিটামিন এ সেবন করলে বিভিন্নরকম স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্ভাবনা থাকে।
লেখকের মন্তব্য
উপরোল্লিখিত তথ্যগুলো ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার, অভাবজনিত রোগ, প্রতিকার ও অতিরিক্ত গ্রহণের ক্ষতিকারক দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি তথ্যগুলো আপনাদের জন্য সহযোগি হবে। তথ্যগুলো বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে তবুও ভিটামিন সংক্রান্ত যেকোনো চিকিৎসা গ্রহণের পূর্বে কোনো বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়ার পরামর্শ রইল।
সেই সাথে বিনীতভাবে জানাচ্ছি যে, এই আর্টিকেলে কোনো প্রকার সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জনের প্রয়োজন হলে আপনার সুচিন্তিত মতামত সাদরে গ্রহণযোগ্য। আপনার মতামত জানাতে কমেন্টবক্সে কমেন্ট করতে পারেন। ধন্যবাদ।
আপনার সুচিন্তিত মতামত দিয়ে MrDorpon কে আরও সমৃদ্ধ করতে সহযোগিতা করুন। আপনার মতামতটি রিভিউর পর Published করা হবে।
comment url