২৫ মার্চ কালো রাতের ঘটনা কি? অপারেশন সার্চলাইট কাকে বলে?
২৫ মার্চ কালো রাতের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক লোমহর্ষক বর্বরোচিত ঘটনা। ১৯৭১ সালের এইদিন গভীর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে অতর্কিতভাবে নিরস্ত্র নিরীহ বাঙালীর ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, হত্যা করেছিল প্রায় ৭,০০০ নিরীহ মানুষকে। বর্তমান তরুণসমাজ জানেনা ২৫ মার্চ কালো রাতের ঘটনা, তারা জানে না অপারেশন সার্চলাইট কাকে বলে, যা খুবই দুঃখজনক।
১৯৭০ এর নির্বাচনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাঘরিষ্ঠতায় বিজয় লাভ করেও যখন ক্ষমতার পালাবদল হয়নি তখন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তুলা হয়। আর এই আন্দোলনকে দমন করতেই ২৫শে মার্চ কালো রাতের সৃষ্টি।
২৫ মার্চ কালো রাতের ঘটনা এবং স্বাধীনতা ঘোষণার সূত্রপাত
১৯৭০ এর নির্বাচনে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি (পিপিপি) শুধুমাত্র তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাঘরিষ্ঠতা লাভ করেন। কিন্তু এই নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তৎকালীন আওয়মী লীগ সার্বিকভাবে (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে) নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করলেও তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো বিভিন্ন অজুহাতে সরকার গঠন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে গড়িমসি করতে থাকে।
তারা বাঙালিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার প্রয়াসে নানা রকম প্ররোচনা শুরু করেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তাকে নষ্ট করতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং জাতীয় অধিবেশনে বসার ব্যাপারে কালক্ষেপণ করতে থাকে। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার কথা থাকলেও শেষ মূহুর্তে তিনি না এসে অন্য একজনকে দিয়ে পরবর্তী নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত জাতীয় অধিবেসন বাতিলের ঘোষণা দেন।
এই বক্তব্য শুনার পর বাঙালিরা ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন এবং উত্তাল মার্চের সূত্রপাত ঘটে। এর ফলশ্রুতিতে বাঙালিদের সাথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও বিহারী জনগণের সংঘাত-সংঘর্ষ নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তারপর আওয়ামী লীগ এবং এর ছাত্র সংগঠন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক হরতাল, অবরোধ ও কারফিউসহ বিভিন্ন কর্মসূচি শেষে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়।
আনুষ্ঠানিকভাবে মার্চের ২৬ তারিখ স্বাধীনতার ঘোষণা আসলেও মূলত এই সমাবেশের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতা ঘোষণার সূত্রপাত ঘটে। উক্ত সমাবেশে উপস্থিত সর্বস্তরের জনগণের সমাগম সমাবেশকে জনসমুদ্রে পরিণত করে। যা পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তাব্যক্তিদের মনে সমগ্র পাকিস্তান জুড়ে কর্তৃত্ব হারানোর ভয় ঢুকিয়ে দেয়। ফলে তারা আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করতে বিভিন্ন পরিকল্পনা করে।
এরই ধারাবাহিকতায় পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাকর্মকর্তারা সমগ্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে নিজেদের মধ্যে সমর্থন যোগাতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তা সেনাআক্রমণে রূপ নেয়। ২৫ মার্চ রাত পৌণে আটটার সময় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সশস্ত্র হামলা এবং ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের বড় বড় শহরগুলোকে দখলে নেওয়ার ন্যাক্কারজনক নির্দেশনা দিয়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেন।
তারপর আনুমানিক রাত ১১.৩০ মিনিটে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ট্যাংক, মেশিনগান ও মর্টার নিয়ে ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালির ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। আনুমানিক রাত ১ টার দিকে তারা পিলখানায় হামলা চালায়। পিলখানায় হামলার সাথে সাথে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্পটে আক্রমণ করে। হত্যা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুমানিক ১০০ জন শিক্ষার্থীসহ ৯ জন শিক্ষককে।
অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকার বরাতে জানা যায় যে, বর্বর পাকিস্তানি সেনারা মার্চের ১ তারিখ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় ১ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটাই প্রথম নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞে ঢাকাসহ পুরো দেশটিকে মহাশ্মশান পরিণত করেছিল, রক্তে রঞ্জিত করেছে বাঙালি জাতির ইতিহাস। আর এই ঘটনার স্বাক্ষী হয়ে আছে ২৫ মার্চ কালো রাত যা দেশপ্রেমী জনতা প্রতিবছর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
অপারেশন সার্চলাইট কাকে বলে?
১৯৭০ এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী তৎকালীন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে দলটির উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন এবং আওয়ামী লীগক সমর্থনকারী সামরিক শক্তির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হত্যার পরিকল্পনা করে । পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর ও জিওসি করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়।
যার তত্ত্বাবধানে মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নেতৃত্বে ২৫ মার্চ মধ্য রাতে ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালির ওপর হামলা চালায় পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী। বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিভীষিকাময় এই কর্মযজ্ঞের নাম দিয়েছিল অপারেশন সার্চলাইট (Operation Searchlight) যা বাংলাদেশের ইতিহাসকে করেছে রক্তাক্ত।
অপারেশন সার্চলাইট এর পূর্ব নাম কি ছিল?
১৯৭০ নির্বাচনের ফলাফলের পরপরই শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা এবং বাঙালি শক্তিকে প্রতিহত করতে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্বপর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ “অপারেশন ব্লিজ” (Operation Blitz) নামের এক জঘন্য পরিকল্পনা করেন। যা পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের শেষ প্রহরে “অপারেশন সার্চলাইট” (Operation Searchlight) নামে পরিচালিত হয়। এই অপারেশনের ফলে বাংলাদেশের পিচঢালা রাজপথ কিংবা গ্রামের মেটো পথ, সর্বত্র রঞ্জিত হয় নিরীহ বাঙালির রক্তে। ইতিহাসের পাতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জন্ম দেয় এক ন্যাক্কারজনক হত্যাযজ্ঞের ঘটনা।
২৫ শে মার্চ কালো রাত বলা হয় কেন?
১৯৭১ সালের এই দিনের শেষ প্রহরে আনুমানিক রাত ১১.৩০ মিনিট হতে রাতব্যাপী পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙালির উপর সশস্ত্র হামলা চালায়। এই বর্বরোচিত হামলায় গভীর রাতে ঘুমে আচ্ছন্ন অবস্থায় প্রায় ১ লক্ষ সাধারণ বাঙালি শহীদ হন। এর ফলশ্রুতিতে স্বাধীন বাংলাদেশে ২৫ শে মার্চকে কালো রাত হিসেবে অবহিত করা হয়।
২৫ শে মার্চ গণহত্যা কি নামে পরিচিত?
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক পরিচালিতা ২৫ শে মার্চের হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা নামে আখ্যায়িত করা হয়। ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য উত্তরসূরি দেশরত্ন শেখ হাসিনা দিনটিকে “জাতীয় গণহত্যা দিবস” হিসেবে আখ্যায়িত করেন। উক্ত সংসদীয় অধিবেশনে নৃশংস এই হত্যাযজ্ঞে নিহত শহীদদের স্মরণে দিবসটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ।
অপারেশন সার্চলাইট এর নীল নকশা কে তৈরি করেন?
১৯৭০ এর নির্বাচনের পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান এবং পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বাঙালির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অনীহা প্রকাশ করে। তারা জাতীয় বিধান সভার কার্যক্রম মার্চ পর্যন্ত স্থগিত করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। তারপর ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সশস্ত্র বাহিনীর এক বৈঠকে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় মার্চ মাসের প্রথম দিকে মেজর জেনারেল খাদিম হোসাইন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর উপর অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনার দায়িত্ব অর্পিত হয়। ১৭ই মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সিওএস জেনারেল হামিদের চুড়ান্ত নির্দেশনায় ১৮ই মার্চ ঢাকা সেনানিবাসে বসে জেনারেল খাদিম হোসাইন রাজা এবং জেনারেল রাও ফরমান আলী অপারেশন সার্চলাইটের নীল নকশা তৈরি করেন।
২৫ মার্চ কালো রাতের ঘটনা সম্পর্কিত কিছু শর্টনোট
- ২৫ মার্চ গণহত্যার সাংকেতিক নাম “অপারেশন সার্চলাইট”।
- অপারেশন সার্চলাইটের পূর্ব নাম “অপারেশন ব্লিজ” (Operation Blitz).
- ২৫ মার্চ গণহত্যার সময় বাংলার গভর্ণর ছিলেন জেনারেল টিক্কা খান।
- ঢাকা শহরে অপারেশন সার্চলাইটের নেতৃত্ব দেন মেজর রাও ফরমান আলী।
- ঢাকার বাহিরে নেতৃত্ব দেন মেজর খাদিম হোসাইন রাজা।
- অপারেশন সার্চলাইট এর নীলনকশা তৈরি করেন জেনারেল টিক্কা খানের তত্ত্বাবধানে মেজর খাদিম হোসাইন রাজা এবং মেজর রাও ফরমান আলী।
- ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করা হয়।
- অপারেশন সার্চ লাইটের মূল দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল টিক্কা খান। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাত ১১.৩০ এর দিকে তার নির্দেশেই নির্মম এই হত্যাযজ্ঞ পরিচালিত হয়।
- ২৫ মার্চকে কালো রাত বলার কারণ হলো ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গভীর রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় অতর্কিত হামলা চালিয়ে অগণিত নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে।
- ২৫ মার্চ কালো রাতের নিহত শহীদদের স্মরণে দিনটিকে “জাতীয় গণহত্যা দিবস” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
- ২০১৭ সালের ১১ই মার্চ সংসদীয় অধিবেশনে দেশরত্ন শেখ হাসিনার প্রস্তাবনায় এই দিনটিকে “জাতীয় গণহত্যা দিবস” হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
- মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৭১ সালের এই এক রাতেই প্রায় ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, গ্রেফতার করা হয়েছিল প্রায় ৩০০০ জনকে।
- ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ছিল বৃহস্পতিবার।
লেখকের মন্তব্য
বাংলাদেশের ইতিহাস রক্তে দিয়ে কেনা ইতিহাস। স্বাধীন বাংলাদেশের মসনদে ডুবে থাকা বর্তমান তরুণ সমাজ রক্তে রঞ্জিত এই ইতিহাস সম্পর্কে খুবই উদাসীন। স্বাধীন বাংলাদেশের এই বিভিষিকাময় ইতিহাসকে তরুণ সমাজের নিকট পুনরুজ্জিবিত করতে এই আর্টিকেলটি রচিত। আশাকরি জ্ঞানপিপাসু তরুণ সমাজ আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে এবং অন্যদেরকেও শেয়ার করে সহযোগিতা করবে।
উপরোক্ত তথ্যগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কিছু পত্রিকা এবং বিশ্বকোষখ্যাত উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত। তবুও এর মধ্যে কোন প্রকার ভুলত্রুটি থাকলে কিংবা কোন প্রকার সংশোধন, সংযোজন বা পরিমার্জনের প্রয়োজন হলে আপনার সুচিন্তিত মতামত কমেন্টবক্সে জানানোর জন্য অনুরোধ রইল।
আপনার সুচিন্তিত মতামত দিয়ে MrDorpon কে আরও সমৃদ্ধ করতে সহযোগিতা করুন। আপনার মতামতটি রিভিউর পর Published করা হবে।
comment url