বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে প্রবেশ, ছাত্র রাজনীতি এবং তাঁর ৪৭৬০ দিনের কারাজীবন

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে প্রবেশ স্কুল জীবনে ঘটলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর সক্রিয় অবস্থান তৈরি হয়েছিল কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রাবস্থায় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে। বঙ্গবন্ধুর ৪৭৬০ দিনের কারাজীবন, অক্লান্ত পরিশ্রম এবং তাঁর দূরদর্শী রাজনৈতিক কৌশলই বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। 
বঙ্গবন্ধুর_রাজনীতিতে_প্রবেশ_ছাত্র_রাজনীতি_এবং_তাঁর_৪৭৬০_দিনের_কারাজীবন
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ছাত্র জীবন ও কর্মজীবনের পুরোটা সময়ই ব্যয় করেছেন বঙ্গভাষা ও বঙ্গমুক্তির প্রত্যয়ে। বহু চড়াই উৎরাই ডিঙ্গিয়ে কাঙ্খিত সেই স্বাধীনতা অর্জিত হলেও এর ফল ভোগ করতে দেয়নি অকৃতজ্ঞ কিছু বাঙালি জনতা।

ভূমিকা

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে প্রবেশ যেমন ছিল নাটকীয়ভাবে স্কুল জীবন থেকে, তেমনি তাঁর ছাত্রজীবন ও ছাত্র রাজনীতির পরিসমাপ্তিও ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনাকাঙ্খিত কল্প কাহিনীর ন্যায়। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৪৭৬০ (মতভেদে কিছুটা কম বেশি হতে পারে) দিন কারাভোগ করেন যা বছরের হিসেবে প্রায় ১৪ বছর। কিন্তু মহান এই ত্যাগী নেতা মাত্র ০৪ বছরও স্বাধীনতার সুখ ভোগ করতে পারেননি। সপরিবারে হত্যার শিকার হোন ক্ষমতালোভী ও স্বার্থান্ধ কিছু নরপিশাচের হাতে। যা বাঙালি জাতির জন্য খুবই দুঃখজনক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা।

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে প্রবেশ

বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল স্কুল জীবন থেকেই। ১৯৩৯ সালে গোপালগঞ্জ মথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলের ছাত্রাবস্থায় তৎকালীন যুক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক এবং খাদ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ পরিদর্শনে গেলে ঘটনাক্রমে সেখানেই কিশোর মুজিবের সাথে তাঁদের প্রথম পরিচয় ঘটে। সে সময় স্কুলঘর মেরামতের দাবি উত্থাপন করে বালক মুজিব তাঁর দলবল নিয়ে তাঁদের সামনে দাঁড়ান।

তখন শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক শেখ মুজিবের দাবির যৌক্তিকতা উপলব্ধি করে সেখানকার জেলা প্রশাসককে স্কুলঘর সংস্কারের নির্দেশনা দেন। একই দিন একই সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক ক্ষমতায় মুগ্ধ হন এবং কিশোর মুজিবের মধ্যে নেতৃত্বের অপার সম্ভাবনা উপলব্ধি করে তাকে গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রসংগঠন গড়ে তোলার পরামর্শ দেন।

ঐ সময় শেখ মুজিবের পিতা শেখ লুৎফর রহমান নালিশের সুরে আফসোস করে বলেছিলেন মুজিব পড়াশুনা করে না, শুধু মানুষের পিছনে দৌঁড়ায় আর মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে বেড়ায়। জবাবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেখ লুৎফর রহমানকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন- “মুজিব একদিন মানুষের মত মানুষ হবে।” হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পরামর্শকে আমলে নিয়ে তিনি গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্র সমাজকে একতাবদ্ধ করে সুসংগঠিত করেন।

পরবর্তীতে তিনি ১৯৩৯ সালে গোপালগঞ্জ মহকুমা মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী এবং গোপালগঞ্জ মহকুমা মুসলিম লীগের ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারী নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৪০ সালে ‘নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে’ (অল ইন্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশন) যোগদান করেন এবং তাঁকে কাউন্সিলর নির্বাচিত করা হয়। একই বছর তিনি ‘নিখিল বাংলা মুসলিম ছাত্র লীগের’ (অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ) কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। একই বছর ১৯৪০ সালে তিনি গোপালগঞ্জ মহকুমা মুসলিম লীগ শাখার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪১ সালে ১০৪ ডিগ্রী জ্বর নিয়ে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং ফলাফল খারাপ হওয়ায় পুনরায় ১৯৪২ সালে পরীক্ষা দিয়ে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। তাই বলা চলে, স্কুল জীবন থেকেই মাত্র ১৯ বছর বয়সে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেভ মুজিবুর রহমানের রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটেছিল।

বঙ্গবন্ধুর ছাত্র রাজনীতি

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে প্রবেশ স্কুল জীবন থেকে হলেও ১৯৪২ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে আই. এ ভর্তি হওয়ার পরই তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন এবং সোহরাওয়ার্দীর ছত্রছায়ায় রাজনীতির উদীয়মান বরপুত্র হিসেবে আখ্যায়িত হন। একই বছর তিনি কলকাতা ছাত্রনেতা আবদুল ওয়াসেক প্রমুখের নেতৃত্বে হলওয়েল সৌধ অপসারণের দাবিতে গড়ে তোলা আন্দোলনে অংশ নেন। মূলত তখন থেকেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতিতে সক্রিয় অবস্থান নিশ্চিত করেন।

হলওয়েল সৌধ অপসারণ আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের অগ্রণী ভূমিকার ফলশ্রুতিতে একই বছর ১৯৪২ সালে তাঁকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। সেসময় চলমান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি মিত্র শক্তির বিরুদ্ধে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (আই.এন.এ) এর সমর্থনকারী আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন।

১৯৪৩ সালে তিনি বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠারে দাবিতে সোচ্চার হন। এর কিছুদিন পর একই বছর তাঁকে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। তিনি ১৯৪৪ সালে কলকাতায় বসবাসরত ফরিদপুরবাসীদের নিয়ে একটি বিশাল কমিউনিটি গড়ে তোলেন এবং এর নামকরণ করেন ‘ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট এ্যাসোসিয়েশন’। পরবর্তীতে সর্বসম্মতিক্রমে তিনি উক্ত এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনোনীত হন।

তাঁর অভাবনীয় সাংগঠনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক কৌশলের ফলশ্রুতিতে ১৯৪৬ সালে গোপালগঞ্জ থেকে আগত বহিরাগত ছেলে শেখ মুজিবুর রহমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের মহাসচিব নির্বাচিতন হন। তাঁর একের পর এক অভাবনীয় সাফল্যের ফলে খুবই অল্প সময়ের ব্যবধানে তৎকালীন মুসলিম লীগের উর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দসহ হোসেন সোহরাওয়ার্দীর পরম স্নেহধন্য হয়ে উঠেন।
বঙ্গবন্ধুর_রাজনীতিতে_প্রবেশ_ছাত্র_রাজনীতি_এবং_তাঁর_৪৭৬০_দিনের_কারাজীবন
তিনি ১৯৪৬ সালে পৃথক পাকিস্তান সৃষ্টির দাবীতে অনুষ্ঠিত ‘গণভোট’ খ্যাত নির্বাচনে বৃহত্তর ফরিদপুর মুসলিম লীগের ‘ওয়ার্কার ইনচার্জ’ এর দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় ‍তিনি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে গিয়ে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব সম্পর্কে কৃষক সমাজসহ সর্বস্তরের জনগণের নিকট জনমত গড়ে তোলেন এবং মুসলিম লীগের পক্ষে ভোট চান। উক্ত নির্বাচনে শুধুমাত্র মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে মুসলিম লীগ বিজয় লাভ করলেও সমগ্র বাংলায় তাঁরা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে সরকার গঠন করেন।

১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ উদ্‌যাপনের সময় কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটে এবং এক পর্যায়ে তা ভয়ানক আকার ধারণ করে। সেই দাঙ্গায় প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে যার অধিকাংশই ছিল মুসলিম। এই দাঙ্গায় মুসলিমদের রক্ষা, দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য রিলিফ ক্যাম্প পরিচালনাসহ সোহরাওয়ার্দীর বিভিন্ন রাজনৈতিক তৎপরতার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

সে সময় শেখ মুজিবুর রহমান অসুস্থ হয়ে পড়লে সোহরাওয়ার্দী তাঁকে কলকাতার ‘ট্রপিকাল স্কুল অব মেডিসিন’ হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৪৬ সালের বি. এ পরীক্ষায় তিনি অংশ গ্রহণ করতে পারেন নি। পরবর্তীতে তিনি ১৯৪৭ সালে অনুষ্ঠিত বি. এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সাথে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন।

১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পর ১৪ আগষ্ট সৃষ্টি হয় বহু কাঙ্খিত পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের। পৃথক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর একই বছর ৭ই সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ যেখানে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি ১৯৪৮ সালের জানুয়ারী মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানভূক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর একই বছরের ৪ জানুয়ারী তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ এবং হয়ে উঠেন পূর্বপাকিস্তানের প্রধান ছাত্রনেতা।

পূর্ব পাকিস্তানের কংগ্রেসের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের বিরোধিতা ফলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই যৌক্তিক প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। আর তখন থেকেই পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভাষা নিয়ে স্নায়ু যুদ্ধ শুরু এবং ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।

এর কিছুদিন পর ১৯৪৮ সালের ২মার্চ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাসসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামী সাংস্কৃতিক সংগঠন তমুদ্দিন মজলিসের যৌথ উদ্যোগে ফজলুল হক মুসলিম হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের ছাত্র কামরুদ্দীন আহমদ এর সভিাপতিত্বে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করেন।

উক্ত সম্মেলনে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সম্মেলন থেকেই ১১ই মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। এরই প্রেক্ষিতে নবগঠিত ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ এর আহ্বানে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট কর্মসূচি পালনকালে সচিবালয়ের সামনে থেকে শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর আরও কয়েকজন সহযোদ্ধাকে গ্রেফতার করা হয়।

সাধারণ ছাত্রজনতাসহ ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ এর নেতৃবৃদ্ধের তীব্র প্রতিবাদের চাপে পড়ে ১৫ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান সহ গ্রেফতারকৃত অন্যান্য ছাত্রদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। মুক্তি পাওয়ার পরপরই শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয় এবং মুজিবের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় শোভাযাত্রা বের করা হয়। উক্ত শোভাযাত্রায় শেখ মুজিবুর রহমান পুলিশের অসহযোগি কার্যক্রম ও অপতৎপরতার প্রতিবাদে ১৭ই মার্চ পুনরায় ধর্মঘটের ঘোষণা দেন।

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৯ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবী আদায়ের আন্দোলনে সমর্থন ও সশরীরে অংশগ্রহণ করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুসহ ০৫জন এবং পরবর্তীতে আরও ২২জন সহ মোট ২৭ জন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিস্কার করেন। ১৯৪৯ সালের ১৭ই এপ্রিল সবাই জরিমানা ও মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব ফিরিয়ে আনলেও শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালের ১৮ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং তৎকালীন ভিসি ড. সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন বঙ্গবন্ধুকে স্থায়ীভাবে বহিস্কার করেন।

বহিস্কার শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগের সময় তিনি বলেছিলেন, “সসম্মানে ছাড়া আর কোনদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণ করব না।” তারপর সুদীর্ঘ ২৩ বছর পর ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও ডাকসু কর্তৃক যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হলে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ১৯৪৯ সালের বহিষ্কার আদেশের মূল কপি ছিঁড়ে ফেলা হয়। দেওয়া হয় বিরল সম্মানের অধিকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন সদস্যপদ। এভাবেই রূপকথার গল্পের মতোই পরিসমাপ্তি ঘটে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছাত্রজীবন ও ছাত্ররাজনীতি।

বঙ্গবন্ধু মোট কতবার গ্রেফতার হন

যুক্তবাংলা ও মুক্তবাংলা বাংলার রাজনৈতিক বরপুত্র বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৩৮ সালে তাঁর স্কুল জীবন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত মোট ১৮ (বিভিন্ন তথ্যসূত্রে মতভেদ আছে) বার গ্রেফতার হন এবং কারাভোগ করেন। এর মধ্যে তিনি ব্রিটিশ ভারতের অধীনে স্কুল জীবনে ০১ বার এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে প্রবেশ করার পর ১৯৪৭ এর দেশ ভাগ থেকে শুরু করে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬’র ছয়দফা আন্দোলন, ৬৯’এর গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বোপরি ৭১’এর মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনার পরিক্রকমায় বহুবার গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করেন।
বঙ্গবন্ধুর_রাজনীতিতে_প্রবেশ_ছাত্র_রাজনীতি_এবং_তাঁর_৪৭৬০_দিনের_কারাজীবন

বঙ্গবন্ধু মোট কত বছর জেলে ছিলেন / একনজরে বঙ্গবন্ধুর কারাভোগ / বঙ্গবন্ধুর ৪৭৬০ দিনের কারাজীবন

বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ৫৫ বছরের জীবনের প্রায় এক চতুর্থাংশ সময় কারাগারের অন্ধকার কুটিরে বন্দি ছিলেন। স্বাধীন বাংলার স্থপতি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জীবদ্দশায় সর্বমোট ৪৭৬০ দিন কারাভোগ করেন। মহান এই নেতার কারাগারে বন্দি দিবসের সংখ্যা নিয়ে কিছুটা মতবিরোধ থাকলেও এই দীর্ঘ সময়ের কাছে এটা খুবই নগণ্য। নিচে একনজরে বঙ্গবন্ধুর কারাভোগের সকল তথ্য উপস্থাপন করা হলো:

ক্র. নং

মেয়াদ

দিনসংখ্যা

গ্রেফতারের কারণ

০১. ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ ০৭ দিন এক হিন্দু কর্তৃক আটককৃত এক মুসলিম সহপাঠীকে ছাড়াতে গিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ্বের কারণে।
০২. ১১ মার্চ ১৯৪৮ থেকে ১৫ মার্চ ১৯৪৮ ০৫ দিন বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পিকেটিং এর সময়।

০৩.

১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ থেকে ২১ জানুয়ারী ১৯৪৯ ১৩২ দিন কর্ডন প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য।

০৪.

১৯ এপ্রিল ১৯৪৯ থেকে ২৮ জুন ১৯৪৯ ৭১ দিন ছাত্রত্ব বাতিলের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘটের সময়।

০৫.

১৯ জুলাই ১৯৪৯ ০১ দিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে।

০৬. 

০৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯ ২৭ দিন [সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ও নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি।]

০৭.

১৪ অক্টোবর ১৯৪৯ থেকে ২৭ ডিসেম্বর ১৯৪৯ ৭৫ দিন প্রচন্ড খাদ্য সংকট দেখা দিলে এবং তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের আগমনে ভুখা মিছিল বের করায়।

০৮.

৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৯ থেকে ২৭ ডিসেম্বর ১৯৫২ ৭৮৯ দিন ঢাকার আরমানিটোলায় সরকারবিরোধী বক্তব্য দেওয়ায় মোগাটুলি থেকে গ্রেফতার হন।

০৯.

৩০ মে ১৯৫৪ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫ ২৬৫ দিন ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয় লাভের পরও অপরাজনীতির শিকার হয়ে তাঁকে কারাগারে যেতে।

১০.

১১ অক্টোবর ১৯৫৮ থেকে ০৭ ডিসেম্বর ১৯৬১ ১১৫৪ দিন আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে রাজনীতি নিষিদ্ধ করলে শেখ মুজিব উক্ত নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বিভিন্ন ককর্মসূচি দিলে গ্রেফতার হয়ে ১৪ কারভোগের পর জামিনে বের হওয়ার পর জেলগেট থেকে হয়রানিমূলক মিথ্যা দুর্নীতি দমন মামলায় পুনরায় গ্রেফতার হন।

১১.

৬ জানুয়ারী ১৯৬২ থেকে ১৮ জুন ১৯৬২ ১৬৩ দিন সরকার বিরোধী কাজের জন্য।

১২.

১৯৬৪ ও ১৯৬৫ সালের বিভিন্ন মেয়াদে ৬৬৫ দিন [সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ও নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি।]

১৩.

পুনরায় ১৯৬৫ সালে বিভিন্ন মেয়াদে ৯০ দিন সমগ্রদেশে ৩২টি জনসভায় অংশগ্রহণকালে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেন।

১৪.

২১ এপ্রিল ১৯৬৫ থেকে ২৫ এপ্রিল ১৯৬৫ ০৫ দিন সিলেট জজকোর্টের গ্রেফতারি পরোয়ানায় ধানমন্ডির ৩২ নং বাড়ি থেকে গ্রেফতার হন।

১৫.

২৮ জানুয়ারী ১৯৬৬ ০১ দিন [সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ও নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি।]

১৬.

৭ এপ্রিল ১৯৬৬ থেকে ১৭ জানুয়ারি ১৯৬৮ ৬১৯ দিন পাবনায় সরকার বিরোধি বক্তব্য দেওয়ার জন্য ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে গ্রেফতার হন।

১৭.

১৮ জানুয়ারি ১৯৬৮ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ৪০২ দিন আগরতলা ষড়যন্ত্রমামলায় গ্রেফতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তি লাভ করেন।

১৮.

২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে ০৮ জানুয়ারী ১৯৭২ ২৮৯ দিন স্বাধীনতার ঘোষনা দেওয়ার জন্য গ্রেফতার করে তাঁকে পাকিস্তান কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।

 

মোট = ৪৭৬০ দিন

 

লেখকের মন্তব্য

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে প্রবেশ, ছাত্র রাজনীতি এবং তাঁর সমগ্র জীবনের পরিসমাপ্তি রূপকথার গল্পের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। এই মহান কিংবদন্তি তাঁর সম্পূর্ণ জীবন ব্যয় করেছেন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের অপামর জনসাধারণে জন্য যা বাংলাদেশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। শুধু তাই নয়, বঙ্গভাষা ও বঙ্গমুক্তির বিভিন্ন ঘটনার পরিক্রমায় তাঁর আয়ুস্কালের একটা বৃহৎ কাটিয়েছেন কারাগারে। 

MrDorpon সর্বদা নির্ভরযোগ্য সূত্র হতে তথ্য সংগ্রহ করে পাঠকদের নিকট সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপনের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় নিয়োজিত। তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তথ্যসূত্রের মতভেদের কারণে সুনির্দিষ্ট তথ্য উপস্থাপনে কিছুটা ব্যত্যয় ঘটে। এরই একটি উদাহরণ হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ৪৭৬০ দিনের কারাজীবন। 

মহান এই নেতার কারাজীবন নিয়ে বিভিন্ন সূত্রের প্রেক্ষিতে কিছুটা মতপার্থক্য বিদ্যমান। তাই আর্টিকেলটিতে কোনো প্রকার সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জনের প্রয়োজনীয়তা পরিলক্ষিত হলে কমেন্টবক্সে আপনার সুচিন্তিত মতামত দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য আগাম ধন্যবাদ। সেই সাথে আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হলে পরিচিতজনদের সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইলো। 




তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নিজস্ব ওয়েবসাইট, দি ডেইলী স্টার বাংলা, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক যুগান্তর, বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারগারের রোজনামচা’, ড. মোহা. এমরান হোসেন রচিত ‘বঙ্গবন্ধু, বঙ্গভাষা ও বঙ্গমুক্তি’ গ্রন্থসহ বঙ্গবন্ধু বিষয়ক বেশ কিছু গ্রন্থ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করেনি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আপনার সুচিন্তিত মতামত দিয়ে MrDorpon কে আরও সমৃদ্ধ করতে সহযোগিতা করুন। আপনার মতামতটি রিভিউর পর Published করা হবে।

comment url