বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা জীবন এবং তাঁর শৈশব ও কৈশোরের গল্প

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা জীবন শুরু হয় কোন স্কুল থেকে, কোন সালে বা কত বছর বয়সে কিংবা বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও কৈশোরের গল্প বিষয়ক খুঁটিনাটি নিয়ে প্রায়শই বিভিন্ন প্রশ্নের সস্মুখীন হতে হয়। বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে আলাপচারিতায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিষয়ক আলোচনা খুবই সাধারণ বিষয়। কেননা বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একে অন্যের পরিপূরক।
বঙ্গবন্ধুর_শিক্ষা_জীবন_এবং_বঙ্গবন্ধুর_শৈশব_ও_কৈশোরের_গল্প
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা জীবন এবং বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও কৈশোরের গল্প শিরোনামে রচিত এই আর্টিকেলটি মূলত অবিসংবাদিত এই নেতার শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবনের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে রচিত।

ভূমিকা

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। অর্থনৈতিক কোন জটিলতা না থাকলেও বিভিন্ন সময় শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা জীবন খুব একটা মসৃন ছিল না।

তিনি ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে উচ্চ মাধ্যমিক ও ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। পরবর্তীতে দেশ ভাগের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে ভর্তি হলে পুনরায় তাঁর শিক্ষা জীবনে বাঁধা আসে।

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা জীবন শুরু হয় কোন স্কুল থেকে

১৯২৭ সালে গিমাডাঙ্গা মাইনর স্কুল থেকে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। তখন তাঁর বয়স ছিল সাত বছর। বিদ্যালয়টি সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য শর্টনোট আকারে নিচে উপস্থাপন করা হলো:
  • স্কুলটি ১৯১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • শেখ পরিবারের খান সাহেব শেখ মোশাররফ হোসেন স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন।
  • বঙ্গবন্ধুর কারাগারে রোজনামচা গ্রন্থে স্কুলটিকে শুধু মাত্র মাইনর স্কুল নামে লিপিবদ্ধ করা হয়।
  • অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে বলা হয় এম.ই স্কুল।
  • শেখ মুজিব আমার পিতা গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা জীবন শুরু হওয়া স্কুলের নাম বলা হয় গীমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়।
  • উপরিউক্ত তথ্যাবলি বিশ্লেষণ পূর্বক অনুমেয় যে স্কুলটির নাম সম্ভবত গীমাডাঙ্গা মাইনর স্কুল ছিল যা পরবর্তীতে গীমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নামান্তর করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও কৈশোরের গল্প

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো মহান ব্যক্তির শৈশবে ঘটে যাওয়া গল্পের কোনো অন্ত নেই। এর মধ্যে কয়েকটি ঘটনা সম্পর্কে সংক্ষেপে নিচে উপস্থাপন করা হলো:

শেখ মুজিবুর রহমানের বাল্য বিবাহের কারণ: শেখ ফজিলাতুননেছা রেনুর বয়স যখন ৩ বছর এবং তার বড় বোন শেখ জিন্নাতুননেছা জিন্নি’র বয়স যখন ৫ বছর তখন তাদের পিতা শেখ জহরুল হক ইন্তিকাল করেন। ঐ সময় মুসলিম পারিবারিক আইনে পিতার জীবদ্দশায় পুত্র ইন্তিকাল করলে পুত্রের সন্তান-সন্ততি সম্পত্তির মালিক হতে পারতেন না।

সে কারণে শেখ জহরুল হকের পিতা অর্থাৎ শেখ ফজিলাতুননেছার দাদা শেখ আবুল কাশেম তাঁর দুই পৌত্রী শেখ জিন্নাতুননেছা ও শেখ ফজিলাতুন্নেছাকে তাঁর একই বংশের দুই সন্তান শেখ আবদুল কুদ্দুস এর পুত্র শেখ মুহাম্মাদ মুসা ও শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বিয়ে দিয়ে দুই পৌত্রীর নামে সমুদয় সম্পত্তি লিখে দেন।

অধিকার আদায়ে কিশোর শেখ মুজিবুর রহমানের সাহসিকতা: ১৯৩৯ সালে তৎকালীন ‍যুক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক এবং খাদ্যমন্ত্রী ও পরবর্তীকালে বাংলা প্রদেশ ও পাকিস্তানের ৫ম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপালনকারী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ আসেন। তারা সেখানে গোপালগঞ্জ মথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলেও পরিদর্শনে যান। পরিদর্শন শেষে ফেরার সময় শেখ মুজিবুর রহমান তাদের পথরোধ করে হাজির হন।

তখন শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক জিজ্ঞেস করেন কি চাও? দ্বিধাহীন চিত্তে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, আমরা গোপালগঞ্জ মথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশনারি হাই স্কুলের ছাত্র। আমাদের স্কুলের হোস্টেলের ছাদে ফাটল ধরেছে এবং স্কুল ঘরে বর্ষার পানি পড়ে। ছাদ সংস্কারের আর্থিক সাহায্য না দিলে রাস্তা ছাড়া হবে না।

তাঁর সৎসাহসে মুগ্ধ হয়ে ছাদ সংস্কারের জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়ে যান শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক। শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবুর রহমানের এমন সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে গোপালগঞ্জে মুসলিম লীগের শাখা ও মুসলিম ছাত্র সংগঠন গড়ে তুলার পরামর্শ দেন।

কৈশোরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শেখ মুজিবুর রহমান: মাত্র অষ্টম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় ১৯৩৮ সালে খুলনার বাগেরহাটের কলাতালা গ্রামের হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উভয় সম্প্রদায়ের কয়েকশ ঘরবাড়ি পুড়ে ছারখার হয় এবং শতাধিক মানুষ হতাহত হলে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে বিধ্বস্ত এলাকায় গিয়ে ত্রাণ বিতরণ করেন এবং শ্লোগান দেন “হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই, দেশে আমরা শান্তি চাই।”
বঙ্গবন্ধুর_শিক্ষা_জীবন_এবং_বঙ্গবন্ধুর_শৈশব_ও_কৈশোরের_গল্প
প্রতিবাদী কিশোর শেখ মুজিবুর রহমান: ১৯৪১ সালে পাবলিক স্কুলের এক মুসলিম ছাত্রকে হিন্দু ছাত্ররা অন্যায়ভাবে মারপিট করলে এবং শিক্ষকবৃন্দ এর ন্যায্য বিচার না করায় কিশোর শেখ মুজিবুর রহমান ন্যায় বিচারের দাবীতে সকল মুসলমান ছাত্রদের নিয়ে ক্লাস বর্জন করে স্কুলের মাঠে সমবেত হন। তারপর প্রধান শিক্ষক বাবু নরেন্দ্রনাথ দাশ গুপ্তের কাছে গিয়ে বলেন, যে স্কুলে মুসলমান ছাত্রদের নিরাপত্তা নাই সেখানে তারা পড়তে পারে না। আগামীকাল থেকে মুসলমান ছাত্রদের জন্য নতুন স্কুল খোলা হবে।

পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষক স্কুলের সেক্রেটারীকে সাথে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে গিয়ে শেখ মুজিবকে উদ্দেশ্য করে প্রধান শিক্ষক বলেন, খোকা আমরা তোমার পিতৃতুল্য। আমি তোমাদের বাসায় এসে তোমাকে অনুরোধ করা, ক্ষমা চাওয়ার সামিল। পরিশেষে বিষয়টি এখানেই সুরাহা হয়।

বঙ্গবন্ধুর শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত স্থান

আমাদের প্রত্যেকের শৈশবের দুরন্তপনার কিছু মধুর স্মৃতি আছে, আছে স্মৃতি বিজড়িত কিছু স্থান। একটা নির্দিষ্ট বয়স শেষে সেসব শৈশব স্মৃতি এবং স্মৃতিঘেরা সেই স্থানগুলো মনকে নাড়া দেয়। স্মৃতিপটে ভেসে উঠে শৈশবের দুরন্তপনার নানাবিধ ঘটনা এবং এর সাথে জড়িত স্থানগুলো। নিচে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়তি কিছু স্থান শর্টনোট আকারে উপস্থাপন করা হলো:
  • বাল্যকালে বঙ্গবন্ধু যে নদী দিয়ে চলাচল করত সে নদীর নাম ছিল বাইগার নদী।
  • শৈশবকালে বঙ্গবন্ধু যে ঘাটে গোসল করতেন সে ঘাটের নাম হিজল তলা।
  • বঙ্গবন্ধুর পরিবারে ছোট তালাব ও বড় তালাব নামে দুটি পুকুর ছিল। সেখানেও বঙ্গবন্ধুর কিছু মধুর স্মৃতি আছে।
  • বঙ্গবন্ধু বাল্যকালে বালিশা আমগাছ নামক একটি গাছের ডাল পালায় বিভিন্ন রকম দুরন্তপনায় মেতে উঠতেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রিয় খেলা কি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। বঙ্গবন্ধুর ফুটবল খেলা বিষয়ক কিছু তথ্য শর্টনোট আকারে নিচে উপস্থাপন করা হলো:
  • বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের ফুটবল টিমের অধিনায়ক ছিলেন।
  • ১৯৪০ সালে মিশন স্কুলের শেখ মুজিবুর রহমানের ফুটবল টিমের সাথে গোপালগঞ্জ অফিসার্স ক্লাবের একটি প্রীতি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়।
  • উক্ত অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের পিতা শেখ লুৎফর রহমান।
  • ফুটবল মাঠে শেখ মুজিবুর রহমান স্টাইকার হিসেবে খেলতেন।
  • এছাড়াও তিনি ঢাকার ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের হয়ে ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতেন।

বঙ্গবন্ধু কত বছর বয়সে প্রথম কারাবরণ করেন

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের সূত্রমতে ১৯৩৮ সালের মার্চ কিংবা এপ্রিল মাসে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে সম্পর্ক একটু খারাপ চলছিল। এরই প্রেক্ষিতে শেখ মুজিবুর রহমানের এক বন্ধুকে হিন্দুরা ধরে নিয়ে আটকে রাখে। শেখ মুজিবুর রহমান গিয়ে তাদেরকে অনুরোধ করেও ছাড়াতে না পেরে মারপিটের মাধ্যমে তাঁর বন্ধুকে ছিনিয়ে আনেন।

মারপিটের এই ঘটনার প্রেক্ষিতে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে মামলা হয় এবং তিনি জেলে যান। সাতদিন কারাভোগের পর জামিন পান এবং আপোষ রফার মাধ্যমে মামলার নিষ্পত্তি হয়। এটিই ছিল তাঁর জীবনে প্রথম কারাবরণ।

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা জীবন

শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল ও প্রতিপত্তিখ্যাত হলেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁর শিক্ষা জীবন ছিল মন্থর। শারীরিক জটিলতার কারণে তাঁর লেখা পড়ায় বিভিন্ন সময় বাঁধাগ্রস্ত হয়। অবশ্য সকল প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে তিনি উচ্চ শিক্ষা অর্জনে সক্ষম হন। নিচে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা জীবন ঘটিত প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের বিভিন্ন তথ্যাবলী সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো।

বঙ্গবন্ধুর প্রাথমিক শিক্ষা জীবন

নিচে বঙ্গবন্ধুর প্রাথমিক শিক্ষা জীবনের সাথে সম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য শর্টনোট আকারে উপস্থাপন করা হলো:
  • সাত বছর বয়সে ১৯২৭ সালে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়।
  • বঙ্গবন্ধুর প্রথম শিক্ষা জীবন শুরু হয় তৎকালীন গিমাডাঙ্গা মাইনর স্কুল থেকে যা পরবর্তীতে গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে নামান্তর করা হয় এবং বর্তমানে স্কুলটির গিমাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
  • পরবর্তীতে নয় বছর বয়সে তিনি গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং এখান থেকেই তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন।
  • বঙ্গবন্ধুর প্রাথমিক শিক্ষার জন্য তিন জন পারিবারিক শিক্ষক ছিলেন।
  • ইসলাম ধর্ম শিক্ষার জন্য একজন মৌলভী ছিলেন। তাঁর কাছে বঙ্গবন্ধু আমপারা শিখতেন।
  • সাধারণ শিক্ষার জন্য ছিলেন পণ্ডিত সাখাওয়াত উল্লাহ। তাঁর কাছে তিনি বাংলা বর্ণমালা ও নামতা পড়তেন।
  • তৃতীয় জন ছিলেন কাজী আবদুল হামিদ। তাঁর কাছে পড়তেন কবিতা, গল্প ও ইতিহাস।
বঙ্গবন্ধুর_শিক্ষা_জীবন_এবং_বঙ্গবন্ধুর_শৈশব_ও_কৈশোরের_গল্প

বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমিক শিক্ষা জীবন

বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমিক শিক্ষা জীবনে ঘটিত বিভিন্ন ঘটনার গরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলী শর্টনোট আকারে নিচে উপস্থাপন করা হলো:
  • ১৯৩৪ সালে ৭ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তিনি বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন।
  • বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত অবস্থায় তাঁর বয়স ছিল ১৪ বছর।
  • এ রোগে আক্রান্তের ফলে তাঁর হৃৎপিন্ড ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল।
  • চিকিৎসার জন্য তাঁর বাবা তাঁকে কলকাতা নিয়ে যান।
  • কলকাতার তৎকালীন খ্যাতনামা ডাক্তার শিবপদ ভট্টাচার্য ও এ. কে রায় তাঁর চিকিৎসা করেন এবং প্রায় দুই বছর চিকিৎসা শেষে তিনি আরোগ্য লাভ করেন।
  • ১৯৩৬ সালে তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান মাদারীপুরের সেরেস্তাদার হিসেবে বদলী হলে স্বপরিবারে তাঁরা সেখানে চলে যান।
  • পুনরায় তিনি ১৯৩৬ সালে মাদারীপুরের ইসলামিয়া হাইস্কুলে ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হন।
  • মাদারীপুরের ইসলামিয়া হাইস্কুলটি বর্তমানে ‘দি ইউনাইটেড ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে পরিচিত।
  • ১৯৩৬ সালে মাদারীপুরে ইসলামিয়া হাইস্কুলে পড়ার সময় শেখ মুজিবুর রহমান চোখ গুকোমা নামক রোগে আক্রান্ত হন।
  • পুনরায় তাকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়।
  • কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০ দিনের মধ্যে ড. টি আহমদের নেতৃত্বে তাঁর দুটি চোখেরই অপারেশন করা হয়।
  • ১৯৩৬ সালের এই অপারেশনের পর থেকেই তিনি চশমা পড়া শুরু করেন।
  • ১৯৩৭ সালে বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান পুনরায় গোপালগঞ্জে ফিরে আসেন।
  • গোপালগঞ্জে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু নতুন উদ্যমে গোপালগঞ্জ মথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে পুনরায় ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হন।
  • তাঁর সহপাঠী ও বন্ধুরা তাঁকে পিছনে ফেলে উপরের ক্লাসে উন্নীত হওয়ায় তিনি গোপালগঞ্জে ফিরে এসেও পূর্বের স্কুলে ভর্তি না হয়ে গোপালগঞ্জ মথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন।
  • গোপালগঞ্জ মথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারক মথুরানাথ বোস।
  • ১৯৫০ সালে স্কুলটিকে বিলুপ্ত করে সেখানে স্থাপিত হয় মহাবিদ্যালয় এবং নামকরণ করা হয় ‘কায়েদে আজম মেমোরিয়াল কলেজ।’
  • ১৯৫৮ সালে স্কুলটিকে ডিগ্রী কলেজে উন্নীত করা হয়।
  • স্বাধীনতার পর কলেজটির নাম হয় বঙ্গবন্ধু মহাবিদ্যালয়।
  • ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে জাতীয়করণ করে নামকরণ করা হয় ‘সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ’। বর্তমানে এটি ‘সরকারি বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’ নামে পরিচিত।
  • বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক শিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ গরীব শিক্ষার্থীদের সাহায্য করার জন্য ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ নামক একটি সমিতি গঠন করেন।
  • উক্ত সমিতিতে বঙ্গবন্ধু প্রত্যেক রবিবার অন্যদের সাথে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুষ্ঠির চাল উঠাতেন।
  • ‘মুসলিম সেবা সমিতির’ প্রতিষ্ঠাতা কাজী আবদুল হামিদের মৃত্যুর পর অন্য এক মুসলিম শিক্ষক সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উক্ত সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
  • গোপালগঞ্জ মথুরানাথ ইনস্টিটিউ মিশন স্কুলে শিক্ষার্থীদের ক্যাপ্টেন ছিলেন বঙ্গবন্ধুে শেখ মুজিবুর রহমান।
  • শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪১ সালে ১০৪ ডিগ্রী জ্বর নিয়ে গোপালগঞ্জ মথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন (বর্তমান এসএসসি) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং জ্বরের কারণে তাঁর ফলাফল খারাপ হয়।
  • ১৯৪২ সালে একই স্কুল থেকে তিনি পুনরায় মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন।

বঙ্গবন্ধুর উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক শিক্ষা জীবন

বঙ্গবন্ধুর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা জীবনে নানারকম প্রতিবন্ধকতা থাকলেও বিনা বাঁধায় তিনি উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। নিচে বঙ্গবন্ধুর উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা জীবন বিষয়ক তথ্যাবলী শর্টনোট আকারে উপস্থাপন করা হলো:
  • ১৯৪২ সালে মেট্রিকুলেশন পাস করার পর একই বছর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে তিনি আই. এ (বর্তমান এইচএসসি) শ্রেণিতে ভর্তি হন।
  • ১৯৬০ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদের নামানুসারে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের নামকরণ করা হয় মৌলানা আজাদ কলেজ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত কলজকাতায় অবস্থিত এটি একটি সরকারি কলেজ। ব্রিটিশ ভারতের মুসলিম জনগনের মধ্যে ইসলামি শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষা প্রচারের লক্ষ্যে বাংলার তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী এ.কে ফজলুল হকের ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় ১৯২৪ সালের ৯ ডিসেম্বর বাংলার তৎকালীন গভর্ণর লর্ড লিটন কলেজটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বিশিষ্ট মুসলিম ব্যক্তিত্ব হাজি মুহাম্মদ মুহসিন কলেজ প্রাঙ্গনে জমি দান করেন।
  • বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামিয়া কলেজের বেকার হোস্টেলে থাকতেন।
  • বেকার (BAKER) হোস্টেলের নামকরণ করা হয় একজন ইংরেজের নামানুসারে।
  • তিনি ১৯৪৫-১৯৪৬ শিক্ষাবর্ষে বেকার হোস্টেলের ২৪ নম্বর কক্ষে থাকতেন।
  • বেকার হোস্টেলের ২৪ নম্বর কক্ষটি হোস্টেলের তৃতীয় তলায় অবস্থিত।
  • ১৯৪২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামিয়া কলেজের বেকার হোস্টেলের ছাত্র ইউনিয়ন সংসদের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন।
  • ১৯৪৪ সালে তিনি কৃতিত্বের সাথে আই. এ পাস করেন।
  • একই বছর তিনি কলকাতার ফরিদপুর ডিস্ট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
  • আই.এ পাস করার পর ১৯৪৪ সালে একই কলেজে তিনি ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয় নিয়ে বি.এ ভর্তি হন।
  • দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪৩-৪৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় নিপীড়িত মানবতার সেবার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় একটি রিলিফ ক্যাম্প খুলেন।
  • তিনি ১৯৪৬ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্রসংসদের সেক্রেটারি নির্বাচিতন হন।
  • ১৯৪৬ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় আত্মনিয়োগ করায় শেখ মুজিবুর রহমান অসুস্থ হয়ে পড়লে হোসেন শহীদ সোরাওয়ার্দী তাঁকে ট্রপিকাল স্কুল অব মেডিসিন হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করেন।
  • ১৯৪৬ সালে শেখ মুুজিবুর রহমানের বি. এ পরীক্ষা দেওয়ার কথা থাকলেও ১৯৪৭ সালে তিনি বি. এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং কৃতিত্ত্বের সাথে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রী অর্জন করেন।
  • ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে ফরিদপুর জেলার নির্বাচনী প্রচারণার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং ১৯৪৬ এর হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকায় রিলিফ ক্যাম্প পরিচালনার জন্য তিনি ১৯৪৬ সালে বি. এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। কারো কারো মতে, শেখ মুজিবুর রহমান অসুস্থতার কারণে টেস্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পরায় তিনি ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি।
  • বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কলকাতার ছাত্রজীবন ছিল ১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত মোট পাঁচ বছর।
  • ভারত বিভক্তির পর শেখ মুজিবুর রহমান তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানভূক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন।
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন ও অংশগ্রহণ করায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ তাঁকেসহ আরও পাঁচজন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিস্কার করেন।
  • বহিস্কারের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এলএলবি দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র ছিলেন।
  • সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্শষ বঙ্গবন্ধুসহ ২৭ জন শিক্ষার্থীকে বহিস্কার করেন। এদের মধ্যে লুলু বিলকিস নামের একজন মেয়ে শিক্ষার্থীও ছিল।
  • ১৯৪৯ সালের ৩১ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়।
  • বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহিস্কৃত সকল শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব ফিরে পেতে ১৫ রূপী জরিমান এবং পরিবার কর্তৃক মুচলেকা প্রদানের শর্তারোপ করেন।
  • জরিমানা ও মুচলেকা প্রদানের শেষ তারিখ ছিল ১৭ এপ্রিল ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ।
  • পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া বাকি সবাই জরিমান ও মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে মুক্তি পায় এবং ছাত্রত্ব ফিরে পায়।
  • জরিমানা ও মুচলেকা না দেওয়ায় ১৯৪৯ সালের ১৮ এপ্রিল তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবুর রহমানকে স্থায়ীভাবে বহিস্কার করেন।
  • ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবীতে ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে অবস্থানকালীন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় এবং একই বছর জুলাই মাসের শেষের দিকে তিনি জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন।
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, সসম্মানে ছাড়া আর কোনদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পন করব না। এবং সেই দিন থেকেই বঙ্গবন্ধুর ছাত্রজীবনের সমাপ্তি ঘটে।
  • সুদীর্ঘ ২৩ বছর পর ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং ডাকসু সম্মিলিতভাবে এক বিশেভ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আমন্ত্রণ জানানো হয় বঙ্গবন্ধুকে। তাঁর উপস্থিতিতে ১৯৪৯ সালের বহিস্কার আদেশের মূল কপি ছিঁড়ে ফেলা হয়। বিরল সম্মানের অধিকারী হিসেবে তাঁকে প্রদান করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন সদস্যপদ।
  • ৬১ বছর পর ২০১০ সালের ১৪ আগস্ট দুপুর ১২ টা ২০ মিনিটের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভা বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছাত্রত্ব বাতিলের আদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করে।

লেখকের মন্তব্য

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী কয়েকটি শব্দ, কয়েকটি আর্টিকেল কিংবা কয়েকটি বই লিখে শেষ করা যাবে না। এমন মহান ব্যক্তির জীবনী পাঠের আকাঙ্খাও ফুরাবার নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার লেখক কিংবা ব্লগার বাঙালি জাতির এই মহান নেতা সম্পর্কে গবেষণা করছেন এবং লিখছেন।

এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা জীবন নিয়ে রচিত এই আর্টিকেলটি তাঁর জীবনী নিয়ে গবেষণা করা এই অধমের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। নির্ভরযোগ্য উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করে নির্ভুল তথ্য সরবরাহ করতে সর্বাত্মক চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না।

তবুও কোন ভুল-ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে কিংবা কোন তথ্য সংযোজন-বিয়োজনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলে কমেন্টবক্সে আপনার সুচিন্তিত মতামত পেশ করুন। সেই সাথে আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হলে আপনার পরিচিতজনের সাথে শেয়ার করার জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ করা হলো।



তথ্যসূত্র: বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারগারের রোজনামচা’, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রচিত ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’, ড. মোহা. এমরান হোসেন রচিত ‘বঙ্গবন্ধু, বঙ্গভাষা ও বঙ্গমুক্তি’ গ্রন্থসহ বঙ্গবন্ধু বিষয়ক অসংখ্য গ্রন্থ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করেনি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আপনার সুচিন্তিত মতামত দিয়ে MrDorpon কে আরও সমৃদ্ধ করতে সহযোগিতা করুন। আপনার মতামতটি রিভিউর পর Published করা হবে।

comment url