গাভীর ওলান প্রদাহ রোগের চিকিৎসা এবং এর কারণ ও লক্ষণ
গাভীর ওলান প্রদাহ রোগের চিকিৎসার সফলতা নির্ভর করে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর প্রকারভেদ, আক্রান্তের তীব্রতা, উপযুক্ত ঔষধ নির্বাচন ও বিধি মোতাবেক ঔষধ প্রয়োগের উপর। এ রোগের চিকিৎসা যত দ্রুত হবে সফলতার সম্ভাবনা তত বেশি হবে। তাই পশুর ওলান প্রদাহ রোগের লক্ষণ দেখার সাথে সাথে চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
দুগ্ধজাত খামারের জন্য ওলনা প্রদাহ রোগের ভয়াবহতা এতটাই প্রখর যে, সময়মত চিকিৎসা না করলে এ রোগের সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ গ্যাংগ্রিনাসে পরিণত হতে পারে। যার ফলে অনেক সময় ওলান খসে পড়ে কিংবা অপারেশন করে কেটে ফেলে দিতে হয়।
ভূমিকা
যেকোনো গবাদি পশু কিংবা গাভীর ওলানের ব্যাথাজনিত সমস্যাই হচ্ছে ওলান প্রদাহ রোগ। ইংরেজীতে এই রোগকে Mastitis বলে। গবাধি পশুর খামার ব্যবস্থাপনায় ওলান প্রদাহ রোগ খুবই ক্ষতিকর ও কমন একটি ব্যধি। সাধারণত অধিক দুধ উৎপাদনশীল গাভী এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। এই রোগের কারণ সম্পর্কে অবগত হয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগ্রহণের মাধ্যমে পশুকে এই রোগ থেকে দূরে রাখা সম্ভব।
এছাড়াও পশুর মধ্যে ওলান প্রদাহ রোগের লক্ষণ দেখা দিলে প্রাথমিক অবস্থায় গাভীর ওলান প্রদাহ রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে গাভীকে পরিপূর্ণ সুস্থ করা সম্ভব। তাই গবাদি পশুর খামার ব্যবস্থাপনায় বিশেষ করে দুগ্ধজাত খামার ব্যবস্থাপনায় ওলনা প্রদাহ রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান আহোরণ করা প্রত্যেক খামারীর জন্য অত্যাবশ্যকীয় বিষয়।
ওলান প্রদাহ রোগের জীবাণুর নাম কি
মূলত ২৫৭টি জীবাণুর সংক্রমণে পশু ওলান প্রদাহ রোগে আক্রান্ত হয়। ব্যাকটেরিয়া, মাইকোপ্লাজমা, ছত্রাক, শৈবাল ইত্যাদি জীবাণু দ্বারা এ রোগ সৃষ্টি হয়। নিচে ওলান প্রদাহ রোগ সৃষ্টিকারী উল্লেখযোগ্য কিছু জীবাণুর নাম লিপিবদ্ধ করা হলো:
- ব্যাকটেরিয়া: সেটফাইলোকক্কাস ওরিয়াস, স্ট্রেপটোকক্কাস এগালেকশিয়া, স্প্রেপ, ডিসএগালেকশিয়া, স্ট্রেপ, ইউবেরিস, করাইনিবব্যাকটেরিয়াম বোভিস, স্টেফাইলোকক্কাস এপিডারমিডিস ইত্যাদি।
- মাইকোপ্লাজমা: মাইকোপ্লাজমা বোভিস, মাইকোপ্লাজমা বোভিজেনিটালিয়াম, মাইকো প্লাজমা এলকালেসেন্স ইত্যাদি।
- ছত্রাক: ট্রাইকোস্পোরন, এসপারজিলাস ফিউমিগেটাস, এসপারজিলাস নডিউলাস, ক্যানডিড অ্যালবিক্যানস, ক্রিপ্টোকক্কাস নিওফরমেন্স ইত্যাদি।
- শৈবাল: প্রোটোথিকা ট্রাইফোরা এববং প্রোটোথিকা জুপফি ইত্যাদি।
উপরোল্লিখিত জীবাণুগুলো সাধারণত নিম্নোক্ত উৎসের মাধ্যমে পশুকে সংক্রমিত করে:
- পশুর ওলান এবং বাঁট সংক্রমিত মেঝের সংস্পর্শে আসলে।
- একটি বাঁটে সংক্রমিত হওয়ার পর স্বভাবতই অন্যান্য বাঁটেও অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
- কতিপয় জীবাণু ওলানে স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে। পশুর ওলানে আঘাতজণিত কারণে উক্ত জীবাণু বংশবিস্তার করে সংক্রমিত করে।
- ওলানের বাঁট সরাসরি নোংরা সাথে লেগে কিংবা দুধ দোহনকারীর হাত হতে পশু সংক্রমিত হতে পারে।
- ওলানের ছিদ্র দিয়ে জীবাণু প্রবেশ করে সংক্রমিত হতে পারে।
ওলান প্রদাহ রোগের কারণ
সাধারণত নিম্নোক্ত কারণে গাভীর ওলান প্রদাহ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি পরিলক্ষিত হয়:
- ত্রুটিপূর্ণ দুধ দোহন, বাঁছুরের দাঁতের আঘাত কিংবা বাহ্যিক বস্তুর আঘাতজনিত কারণে পশুর ওলান প্রদাহ রোগ দেখা দিতে পারে।
- ওলানের বাঁটে বিশেষ করে বাঁটের মুখে কোন প্রকার ক্ষত থাকলে সেখান থেকে জীবাণু সংক্রমিত হয়ে ওলান প্রদাহ রোগ হতে পারে।
- সাধারণত অধিক দুধ উৎপাদনশীল গাভী ওলান প্রদাহ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
- বাঁচ্চা প্রসবের প্রথম দুই মাস এই রোগের জন্য গাভী বেশ ঝুঁকিপূর্ণ থাকে।
- গোয়াল ঘরের মেঝে প্রতিদিন সঠিকভাবে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত না করলে এ রোগ সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
- পরিসংখ্যান অনুযায়ী গাভী ৪র্থ বিয়ানের পর এ রোগে আক্রান্তের হার বেশি। তাই ৪র্থ বিয়ানের পর গাভীর প্রতি খুবই সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
- দুধ দোহনের পর সাথে সাথে গাভী শুয়ে পড়লে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এক্ষেত্রে দুধ দোহনের পর কমপক্ষে ২ ঘণ্টা যেন গাভী না শুয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- বড় ওলান ও প্রশস্ত বাঁট সমৃদ্ধ গাভীর ক্ষেত্রে খুবই যত্নশীল হতে হবে। কেননা এ জাতীয় গাভীর ওলান প্রদাহ হওয়ার হার বেশি।
- বাচ্চা প্রসবের পর স্বাভাবিকভাবে গর্ভফুল না পড়লে কিংবা গর্ভফুল পড়তে বিলম্বিত হলে উক্ত গাভীর ওলান প্রদাহ হতে পারে।
- গাভীর বাচ্চা প্রসবে বিঘ্ন ঘটলে কিংবা স্বাভাবিক প্রসব না হলে।
- পশুর জরায়ুতে ইনফেকশন বা সংক্রমন থাকলে।
- দীর্ঘদিন গাভীকে ঘাস খেতে না দিলে।
- অধিক দুধের চাপের কারণে দুধ জমাট বেঁধে এ রোগ সৃষ্টি হতে পারে।
- দীর্ঘ সময় দুধ দোহন থেকে বিরত থাকলেও এ রোগ দেখা দিতে পারে।
- গাভী পূর্বে একবার ওলান ফোলা রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেলে পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ওলানফোলা / ওলান প্রদাহ রোগের প্রকারভেদ
লক্ষণ ও তীব্রতা অনুসারে ওলান প্রদাহ রোগকে ০৬ ভাগে ভাগ করা যায়:
- Per Acute (অতিতীব্র)
- Acute (তীব্র)
- Sub Acute (নাতিতীব্র)
- Chronic (দীর্ঘ মেয়াদী)
- Gangrenous (গ্যাংগ্রিনাস)
- Subclinical (সুপ্ত বা সাবক্লিনিক্যাল)
উপরোক্ত ৬ প্রকার ওলানফোলা রোগ ছাড়াও গাভী যখন দুধ ছাড়া অবস্থায় থাকে আবার বকনা গরু যখন গর্ভবতী হয় তখনো ওলানফোলা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এ ধরনের ওলানফোলা রোগকে শুষ্ক ওলানফোলা রোগ বলে।
ওলান প্রদাহ রোগের লক্ষণ
উপরোল্লিখিত প্রকারভেদ অনুযায়ী ওলান প্রদাহ রোগের লক্ষণগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে অতিতীব্র ও তীব্র ওলান প্রদাহ রোগের লক্ষণগুলো প্রায় একই রকম হয়ে থাকে।
নিচে অতিতীব্র এবং তীব্র ওলান প্রদাহ রোগের লক্ষণগুলো উপস্থাপন করা হলো:
- ওলান অস্বাভাবিকভাবে ফুলে যাবে।
- ওলানে ব্যথা অনুভূত হয় এবং ওলানে হাত দিতে দেয় না।
- ওলান প্রদাহ দেখা দিলে পশুর জ্বর থাকবে। এক্ষেত্রে অতিতীব্র হলে তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রী থেকে ১০৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট হবে এবং তীব্র হলে তাপমাত্রা থাকবে ১০২ ডিগ্রী থেকে ১০৩ ডিগ্রী ফারেনহাইট।
- ওলান সবসময় গরম থাকবে।
- গাভী নিজ বাছুরকেও ওলানের দুধ খেতে বাঁধা দিবে।
- দুধের সাথে ছানার মত জমাট বাঁধা দুধ দেখা যায়।
- বাঁট দিয়ে দুধের পরিবর্তে পানি ও ঘোলাটে দুধ বের হয়। এমনকি পুঁজও বের হতে পারে।
- যে বাঁট আক্রান্ত হয় সেই বাঁট দিয়ে শুধু পানি বের হয়। কখনও কখনও রক্তও আসতে পারে।
- ওলানের অংশ বিশেষ বা বাঁট একদিকে বাঁকা হয়ে যায়।
- পশুর খাদ্য রুচি নষ্ট হয়ে যায় এবং খাবারে অনীহা দেখা দেয়।
- ওলান ফোলার ফলে পশু শুইতে চায় না এবং হাটার সময় খুড়িয়ে হাঁটে।
- এক পর্যায়ে পশুর ওলান শক্ত হতে থাকে।
- ওলানের যে বাঁট আক্রান্ত হয় সেই অংশে ফোঁড়া পরিলক্ষিত হয়।
- আক্রান্ত ওলানে ফোঁড়া ফেটে বের হয়ে যাওয়ার পর ওলান ছোট হয়ে যায়।
- আক্রান্ত বাঁট পরবর্তীতে অন্য বাঁটের তুলনা কিছুটা ছোট হয়ে আসে।
নাতিতীব্র ওলান প্রদাহ রোগের অন্যতম লক্ষণ হচ্ছে-
- এক্ষেত্রে গাভীর জ্বর থাকে না তবে দুধ ও ওলানের সামান্য পরিবর্তন দেখা যায়।
দীর্ঘমেয়াদী ওলানফোলা রোগ ধরনের লক্ষণ প্রকাশ না করে দীর্ঘদিন যাবৎ পশুর মধ্যে স্থায়ী হতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদী ওলান প্রদাহ রোগের লক্ষণগুলো নিম্নরূপ:
- এক্ষেত্রে গাভী কিছুদিন পর পর ওলানফোলা রোগে আক্রান্ত হয় এবং ওলান শক্ত হয়ে যায়।
- দুধ উৎপাদন ক্রামাগত কমতে থাকে।
- অনেক সময় আক্রান্ত বাঁট দিয় দুধ আসে না।
গ্যাংগ্রিনাস হচ্ছে ওলান প্রদাহ রোগের সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ। নিচে গ্যাংগ্রিনাস ওলানফোলা রোগের লক্ষণগুলো উল্লেখ করা হলো:
- দুধ ও ওলানের সুস্পষ্ট পরিবর্তন দেখা যাবে।
- বাঁট দিয়ে মৃতু টিস্যু বা কলা বের হওয়া।
- ওলান থেকে রস বের হওয়া।
- আক্রান্ত স্থান ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া।
- আক্রান্ত স্থান নীল থেকে কালো বর্ণ ধারণ করবে।
- ফোলা স্থানে চাপ দিলে পচপচ শব্দ করবে এবং রক্তনালী নষ্ট হতে থাকবে।
- আক্রান্ত স্থানে ক্ষত এবং আলসারেশন দেখা যাবে।
সুপ্ত বা সাবক্লিনিক্যাল ওলানফোলা রোগের লক্ষণসমূহ নিম্নরূপ:
- এ ধরনের ওলানফোলা রোগে কোন ধরনের বাহ্যিক লক্ষণ প্রকাশ পায় না।
- গাভী স্বাভাবিক থাকে।
- দুধ ও ওলান বা বাঁটে কোন পরিবর্তন দেখা যায় না।
- এ রোগে হঠাৎ করে ১৫ থেকে ৪৫ ভাগ পর্যন্ত দুধ উৎপাদন কমে যায়।
- দুধে উচ্চ মাত্রায় শ্বেতকণিকা ও ব্যাকটেরিয়া থাকে।
- এ প্রকার রোগের প্রাদুর্ভাব তীব্র ওলানফোলা রোগের চেয়েও ১৫-৪০ গুণ বেশি থাকে।
ওলান প্রদাহ রোগ নির্ণয় পদ্ধতি
গাভীর ওলান প্রদাহ রোগের চিকিৎসা পদ্ধতির প্রথম ধাপই হলো রোগ নির্ণয়। সাধারণত পশুর ইতিহাস, ওলান ও বাঁটের অস্বাভাবিক পরিবর্তন এবং দুধের বর্ণ, গন্ধ ও অবস্থা পরীক্ষা করে এই রোগ নির্ণয় করা হয়। তবে সুপ্ত বা সাবক্লিনিক্যাল ওলানফোলা রোগে যেহেতু ওলান ও দুধের বাহ্যিক কোন পরিবর্তন দেখা যায় না সেহেতু নিম্নবর্ণিত পরীক্ষার মাধ্যমে সাবক্লিনিক্যাল ওলান প্রদাহ রোগ নির্ণয় করতে হয়।
- ক্যালিফোর্নিয়া ম্যাস্টাইটিস টেস্ট (সিএমটি): এই টেস্ট দুধ পরীক্ষার জন্য সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি। এখানে দুধে শ্বেত কণিকার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় জেলীর ন্যায় জমাট দ্রবণ তৈরীর মাধ্যমে। এক্ষেত্রে সাধারণত সিনবায়োটিক্স কোম্পানির লিউকোসাইট টেস্ট কিট সর্বাধিক ব্যবহৃত হয় যা বাংলাদেশে অ্যাডভ্যান্স এনিমেল সায়েন্স কোম্পানি বাজারজাত করছে।
- এ পরীক্ষা পদ্ধতিতে একটি প্রশস্ত কাপে পেট্রিডিশে অথবা কোম্পানি কর্তৃক সরবরাহকৃত প্যাডেলে ২ মি.লি. দুধের সাথে ২ মি.লি. রিয়েজেন্ট (এলকাইলারাইল সালফেট) মিশিয়ে নাড়াতে হবে। যদি মিশ্রিত দুধ ১০ সেকেন্ড পরে জেলীর ন্যায় জমাট বাঁধে তাহলে শ্বেত রক্তকণিকার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। যদি জেলীর ন্যায় ঘন দ্রবণ তৈরি হয় তাহলে বুঝতে হবে পশু সুপ্ত ওলানফোলা রোগে ভুগছে। আর যদি ডিমের সাদা অংশের মত ঘন জেলী এবং ঘন বেগুনী বর্ণ ধারণ করে তাহলে বুঝতে হবে পশু ক্লিনিক্যাল ওলানফোলা রোগের পূর্বাবস্থায় আছে।
- হোয়াইট স্লাইড ম্যাস্টাইটিস টেস্ট: এ পদ্ধতিতে ১টি স্লাইডে ৫ ফোঁটা আক্রান্ত দুধের সাথে ২ ফোঁটা সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড নিয়ে টেস্ট করা হয়। যদি দুধ স্বাভাবিক থাকে তবে ২০-৩০ সেকেন্ডর মধ্যে দুধ অস্বচ্ছ ও ঘোলাটে দেখাবে। আর যদি দুধ জমাট বেঁধে যায় তাহলে বুঝতে হবে দুধে হোয়াইট ব্লাড সেল অতিরিক্ত পরিমাণে বেড়ে গেয়ে যা সাবক্লিনিক্যাল ওলান প্রদাহকে নির্দেশিত করে।
- হটিছ এন্ড মিলার টেস্ট: একটি পাত্রে ০.৫ মি.লি. ব্রোমোক্রিসল (০.৫%) এর সাথে ৯.৫ মি.লি. দুধ নিতে হবে এবং ৩৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ২৪ ঘণ্টা রাখতে হবে। যদি রং পরিবর্তন না হয় তাহলে স্ট্রেপটোকক্কাস ডিসএগালেকশিয়া আর যদি হলুদ রং হয় তাহলে স্ট্রেপটোকক্কাস এগালেকশিয়া দ্বারা সংক্রমণ বুঝায়।
- সার্ফ ফিল্ড ম্যাস্টাইটিস টেস্ট: একটি প্যাডেল নেয়া হয় যেখানে ৪টি কাপ আছে। প্রতিবার ব্যবহার করার পর কাপগুলো ধুতে হবে। কাপে ২ মি.লি. দুধ ও ২ মি.লি. রিয়েজেন্ট (সার্ফ এক্সেল ইউলিভার-৩% দ্রবণ) নিয়ে ভাল করে দুধের সাথে মিশাতে হবে। এরপর ২ সেকেন্ড অপেক্ষা করতে হবে। যদি জেরী তৈরী হয় তাহলে বুঝতে হবে পশুটি সুপ্ত বা ক্লিনিক্যাল ওলান প্রদাহ রোগে আক্রান্ত।
এছাড়াও সোমাটিক সেল গণনা করে সরাসরি ওলানফোলা রোগ নির্ণয় করা যায়। এ পদ্ধতিতে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের সাহায্যে দুধের শ্বেত রক্ত কণিকা এবং ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ নির্ণয় করা যায়। এক্ষেত্রে প্রতি মি.লি. দুধে ২ লক্ষ এর অধিক সোমাটিক শেল (শ্বেত রক্ত কণিকা এবং ব্যাকটেরিয়া) থাকলে তা সুপ্ত ওলানফোলা রোগ নির্দেশ করে।
বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল এর অর্থায়েনে পরিচালিত প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহে মেডিসিন বিভাগে একটি স্বয়ক্রিয় সোমাটিক সেল গণনার মেশিন স্থাপন করা হয়েছে যার মাধ্যমে আমরা অতি দ্রুত ও সঠিকভাবে সুপ্ত বা সাবক্লিনিক্যাল ওলানফোলা রোগ নির্ণয় করতে পারি। এই মেশিনের মাধ্যমে দুধের প্রতি নমুনার জন্য মাত্র ১৫০ টাকা খরচ হয়।
গাভীর ওলান প্রদাহ রোগের চিকিৎসা
গাভীর ওলান প্রদাহ রোগ কারণ জেনে চিকিৎসা করলে অবশ্যই ভালো হবে ইনশাআল্লাহ। ভেটেরিনারি ফিল্ডে এখনো সঠিক রোগ নির্ণয় সহজ নয় বিধায় লক্ষণ ভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাাকে। নিম্নবর্ণিত পদ্ধতিতে গাভীর ওলান প্রদাহ রোগের চিকিৎসা করলে পশুর অতিতীব্র, তীব্র, নাতিতীব্র ও সুপ্ত বা সাবক্লিনিক্যাল ওলানফোলা রোগ থেকে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে এবং দুধ কমার কোন সম্ভাবনা থাকবে না। ইনশাআল্লাহ।
নিচে অতি তীব্র বা তীব্র প্রকৃতির ওলানফোলা রোগে আক্রান্ত একটি মাঝারী বা বড় গাভীর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাপত্র বা ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হলো:
ক্র. নং |
ঔষধের নাম |
প্রয়োগবিধি |
০১. |
|
পার্শ্বে উল্লেখিত যে কোন একটি ইনজেকশন ১ অথবা ২ ভায়াল করে ১০ মি.লি. বিশুদ্ধ পানির সঙ্গে মিশিয়ে পর পর ৪-৫ দিন মাংসপেশীতে দিলে বেশি কার্যকরী হয়। |
অথবা, |
|
পার্শ্বে উল্লেখিত যে কোন একটি ইনজেকশন প্রথম দিন 2gm এর একটি ইনজেকশন ১০ মি.লি. ডিস্টিল ওয়াটারের (বিশুদ্ধ পানি)সাথে মিশিয়ে আস্তে আস্তে শিরায় দিতে হবে এবং পরের দিন থেকে 1gm এর একটি ইনজেকশন ১০ মি.লি. ডিস্টিল ওয়াটারের (বিশুদ্ধ পানি)সাথে মিশিয়ে একই নিয়মে ৪-৫ দিন দিতে হবে। |
০২. |
|
পার্শ্বে উল্লেখিত যে কোন একটি এন্টিহিস্টামিন গ্রুপের ইনজেকশন প্রতিদিন ৫-১০ মি.লি করে মাংসপেশীতে পর পর ৪-৫ দিন দিতে হবে। |
০৩. |
|
পার্শ্বে উল্লেখিত ঔষধগুলো মূলত ব্যথানাশক ঔষধ। ওলানে ব্যথা থাকলে যে কোন একটি ইনজেকশন প্রতিদিন ১বার করে ১০-১৫ মি.লি ঔষধ মাংসপেশীতে পর পর ২-৩ দিন দিতে হবে। ব্যথা না থাকলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। |
০৪. |
|
পার্শ্বে উল্লেখিত যে কোন একটি উপাদান কুসুম গরম পানির সঙ্গে মিশিয়ে উক্ত গরম পানিতে পরিস্কার ও নরম ন্যাকড়া চুবিয়ে আক্রান্ত ওলানে ১০-১৫ মিনিট করে দৈনিক ৩-৪ বার শেক দিতে হবে। সাথে ওলান ম্যাসেজ করতে হবে এবং বাঁট থেকে বার বার দুধ বের করে ফেল দিতে হবে। উক্ত দুধ একটি পাত্রে নিয়ে দূরে কোথাও ফেলতে হবে যেন পুনরায় সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে। বার বার শেক দিলে ওলান নরম হবে এবং আস্তে আস্তে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। |
উপরোক্ত ব্যবস্থাপত্রটির ১-৪ পর্যন্ত চিকিৎসা সঠিকভাবে করালে ওলানফোলা প্রায় সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে যাবে। আর তেমন কোনো ঔষধের প্রয়োজন হবে না। ইনশাআল্লাহ। |
এছাড়াও অতি তীব্র ও তীব্র ওলানফোলা রোগের পূর্বে উল্লেখিত লক্ষণ ছাড়াও অনেক সময় বাঁট দিয়ে রক্ত আসে। সেক্ষেত্রে নিম্নের চিকিৎসাপদ্ধতি অনুসরণ করলে পশু দ্রুত আরোগ্য লাভ করে।
ক্র. নং |
ঔষধের নাম |
প্রয়োগবিধি |
০১. |
|
পার্শ্বে উল্লেখিত যে কোন একটি ইনজেকশন ২০ মি.লি. পরিমাণে প্রতিদিন একবার করে মাংসপেশীতে পরপর ৫ দিন দিতে হবে। |
অথবা, |
|
পার্শ্বে উল্লেখিত যে কোন একটি ইনজেকশন ১৫-২০ মি.লি. করে মাংসপেশীতে ১-২ দিন পর পর ৩টি ইনজেকশন দিতে হবে। |
০২. | একই সাথে উপরের ছকে উল্লেখিত ২, ৩ এবং ৪ নং-এ উল্লেখিত ঔষধগুলো যথাযথ নিয়মে অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে। |
কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক ভেটেরিনারিয়ান আক্রান্ত বাঁটে Antimastitis Tube ঢুকিয়ে চিকিৎসা করে থাকেন। নিম্নে চিকিৎসা পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো:
ক্র. নং |
নাম |
প্রয়োগবিধি |
০১. |
|
সম্পূর্ণ দুধ বের করে ফেলে প্রতিটি আক্রান্ত বাঁটে পার্শ্বে উল্লেখিত যেকোন একটি টিউব সিরিঞ্জ বাঁটের ছিদ্রপথে ঢুকিয়ে দিতে হবে। এভাবে প্রতিদিন একটি করে পরপর ২-৪ দিন দিতে হবে। |
গাভীর ওলান প্রদাহ রোগের সর্বশেষ পর্যায় হলো গ্যাংগ্রিনাস। ওলান প্রদাহ রোগ গ্যাংগ্রিনাস পর্যায়ে চলে গেলে পশুর ওলানে পঁচন ধরে এবং খসে পড়তে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তখন অপারেশন করে ওলান কেটে ফেলে দিতে হয়। নিচে গ্যাংগ্রিনাস ওলানফোলা রোগের চিকিৎসাপত্র ও প্রয়োগবিধি উল্লেখ করা হলো:
ক্র. নং |
ঔষধের নাম |
প্রয়োগবিধি |
০১. |
|
পার্শ্বে উল্লেখিত যে কোন একটি ইনজেকশন প্রতিদিন ১-২ ভায়াল করে মাংসপেশীতে পর পর ৫-৭ দিন দিতে হবে। |
অথবা, |
|
পার্শ্বে উল্লেখিত যে কোন একটি ইনজেকশন প্রতিদিন ১-২ ভায়াল করে মাংসপেশীতে পর পর ৫-৭ দিন দিতে হবে। |
অথবা, |
|
পার্শ্বে উল্লেখিত যে কোন একটি ইনজেকশন মাঝারী গাভীর জন্য ১ গ্রাম এবং বড় গাভীর জন্য ২ গ্রাম মাংসপেশীতে প্রতিদিন একবার করে পরপর ৩-৫ দিন দিতে হবে। |
০২. |
|
পার্শ্বে উল্লেখিত যে কোন একটি ইনজেকশন প্রতিদিন ১০ মি.লি. পরিমাণে মাংসপেশীতে পর পর ৫-৭ দিন দিতে হবে। |
০৩. |
|
পার্শ্বে উল্লেখিত যে কোন একটি ইনজেকশন প্রতিদিন ১০-১৫ মি.লি. পরিমাণে মাংসপেশীতে পর পর ৩-৫ দিন দিতে হবে। |
০৪. |
|
পার্শ্বে উল্লেখিত যে কোন একটি ইনজেকশন মাংসপেশীতে একটি করে ২-৩ দিন পর পর মোট ৩টি ইনজেকশন দিতে হবে। |
অথবা, |
|
পার্শ্বে উল্লেখিত যে কোন একটি ইনজেকশন মাংসপেশীতে একটি করে ২-৩ দিন পর পর কমপক্ষে ৩টি ইনজেকশন দিতে হবে। |
০৫. |
|
পার্শ্বে উল্লেখিত যে কোন একটি প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০০ মি.লি করে ৫-৭ দিন পশুর শিরায় দিতে হবে। |
গ্যাংগ্রিনাস ওলানফোলা রোগে ওলানের যে অংশ থেকে টিস্যু খসে পড়ছে সে স্থান নিয়মিত পরিস্কার করতে হবে। মরা-পঁচা টিস্যু কেটে ফেলে দিতে হবে। যদি ওলান সম্পূর্ণরূপে আলাদা হয়ে যায় এবং সুস্থ অংশ ও আক্রান্ত অংশের মধ্যে সুস্পষ্ট লাইন থাকে তাহলে অভিজ্ঞ পশু চিকিৎসকের সাহায্যে অপারেশন করে ওলান কেটে ফেলতে হবে। |
লেখকের মন্তব্য
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, আমাদের দেশের প্রায় ২৯% গাভী ওলান প্রদাহ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। সাধারণত দুধ উৎপাদনকারী গাভীর মধ্যেই ওলান প্রদাহ রোগে আক্রান্তের হার বেশি। তাই লক্ষণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে গাভীর ওলান প্রদাহ রোগের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় সময়মত চিকিৎসার অভাবে আক্রান্ত পশুর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ চিরদিনের জন্য কমে যায়। এমনকি কখনও কখনও রোগের তীব্রতা বেড়ে গেলে অপারেশন করে ওলান কেটে ফেলে দিতে হয়।
আশাকরি গাভীর ওলান প্রদাহ রোগের চিকিৎসা এবং এই রোগের কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিষয়ক এই আর্টিকেলটি খামারীদের জন্য খুবই উপকারী হবে। বিশেষ করে দুগ্ধজাত খামারীদের জন্য বিষয়গুলো সম্পর্কে জানা একান্ত জরুরী। তাই আর্টিকেলটি পড়ে এর গুরুত্ব বিবেচনা করে আপনার পরিচিত খামারীদের নিকট শেয়ার করুন। এছাড়া কোনো তথ্য সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জনের প্রয়োজন হলে কমেন্টবক্সে আপনার সুচিন্তিত মতামত পেশ করুন।
যদিও আর্টিকেলে উল্লেখিত গাভীর ওলান প্রদাহ রোগের চিকিৎসা বিষয়ক যাবতীয় তথ্যাবলী নির্ভরযাগ্য উৎস হতে সংগৃহিত তবুও বাস্তবে এই ব্যবস্থাপত্র প্রয়োগের পূর্বে ভালো কোনো পশু চিকিৎসক কিংবা অভিজ্ঞ কোনো খামারীর পরামর্শ নেওয়া উচিত। অন্যথায় পশুর মধ্যে কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটলে এর দায়ভার MrDorpon কর্তৃপক্ষ বহন করবে না। ধন্যবাদ।
তথ্যসূত্র: উকিপিডিয়া, agricare24.com এগ্রোবাংলা, ড. মাহবুব মোস্তফা রচিত আধুনিক পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণ ও চিকিৎসা এবং দুগ্ধবতী গাভী পালন, ড. মো. জালাল উদ্দিন সরদার, অধ্যাপক, এনিমেল হাজবেন্ড্রী এণ্ড ভেটেরিনারি সায়েন্স বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী কর্তৃক রচিত এবং নূর পাবলিকেশন্স, বাংলাবাজার, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত “লাভজনক পশু পালন ও খামার ব্যবস্থাপনা” ও “গৃহপালিত পশু-পাখির রোগব্যাধি ও আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি” বই । খামার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান অর্জন করতে বই তিনটি আপনার সংরক্ষণে রাখতে পারেন। |
আপনার সুচিন্তিত মতামত দিয়ে MrDorpon কে আরও সমৃদ্ধ করতে সহযোগিতা করুন। আপনার মতামতটি রিভিউর পর Published করা হবে।
comment url