তারুণ্য ধরে রাখতে কি খাওয়া উচিত এবং দীর্ঘ তারুণ্যের ব্যায়াম
তারুণ্য ধরে রাখতে কি খাওয়া উচিত এর উত্তর প্রশ্নের মধ্যেই লুকায়িত। অধিক পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার মানেই যে স্বাস্থ্যসম্মত, বিষয়টি এমন নয়। তাই নিরোগ দীর্ঘ তারুণ্যের জন্য অবশ্যই খাদ্যাভ্যাস ও তারুণ্য ধরে রাখার ব্যায়াম সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন থাকতে হবে এবং অনুসরণ করতে হবে নির্দিষ্ট একজন Nutritionist এর Diet চার্ট।
নির্দিষ্ট Nutritionist এর Diet চার্ট অনুসরণপূর্বক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে নিরোগ তারুণ্য ধরে রাখাতে Pritikin Diet Chart সর্বোত্তম কার্যকরী পদ্ধতি। Pritikin Diet Chart সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমে জানতে হবে "Nathan Pritikin" এবং তাঁর গবেষণার ফল "Pritikin Programme" সম্পর্কে।
ভূমিকা
দীর্ঘ ও নিরোগ তারুণ্য ধরে রাখতে কি খাওয়া উচিত এবং কোন কোন খাবার খাদ্য তালিকা থেকে পরিহার করা উচিত সে সম্পর্কে আমেরিকার বংশদ্ভূত বিশ্বখ্যাত নিউট্রিসনিস্ট নাথান প্রিটিকিন এর দীর্ঘ গবেষণার ফল “প্রিটিকিন প্রোগ্রাম” অনুসরণ করলেই সকল প্রশ্নের অবসান ঘটবে। প্রিটিকিন এর ভাষ্যমতে দীর্ঘ তারুণ্য ধরে রাখতে শুধুমাত্র পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার কিংবা শারীরিক ব্যায়ামই যথেষ্ট নয়। তাছাড়া সভ্যতার কোন ডিজেনারেটিভ রোগই ওষুধের মাধ্যমে নির্মুল করা সম্ভব নয়।
ওষুধে রোগ নিরাময় হয়, এই ভ্রান্ত ধারণার জন্ম হয়েছে কেবলমাত্র বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিকের সফলতাস্বরূপ অপুষ্টিজনিত রোগ ও সংক্রামক রোগ নিরাময়ের ফলে। উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি এবং নতুন নতুন ওষুধ কেবলমাত্র অপুষ্টিজনিত রোগ, যেমন- স্কার্ভি, রিকেট, বেরিবেরি কিংবা সংক্রামক রোগ কলেরা, ম্যালেরিয়া, যক্ষা প্রভৃতি নিরাময় করা সম্ভব হলেও অকালে জীবননাশী সভ্যতার অগণিত ডিজেনারেটিভ রোগ যেমন- হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, আরথ্রাইটিস, হাঁপানি এবং ক্যান্সার প্রভৃতির একটিও ওষুধের মাধ্যমে নির্মূলযোগ্য নয়।
উন্নত চিকিৎসার বদৌলতে এইসব ডিজেনারেটিভ রোগ সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও ওষুধের মাধ্যমে এসব রোগ নির্মূল করার চেষ্টা অনেকটা ফুটো পাত্রে পানি ঢেলে পাত্র পূরনের ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র। কথায় আছে, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। তাই এইসব রোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে রোগ সৃষ্টির পূর্বেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার প্রথম ধাপই হচ্ছে খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে সচেতন হওয়া। তাই সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ তারুণ্য ধরে রাখতে কি খাওয়া উচিত এবং কতটুকু পরিমাণে খাওয়া উচিত সেটা জানার জন্য প্রিটিকিন প্রেগ্রাম একটি উত্তম ডায়েট চার্ট।
ডিজেনারেটিভ রোগ কী?
ডিজেনারেটিভ কোনো নির্দষ্ট রোগ নয়। ডিজেনারেটিভ মানে হলো মানবদেহের শরীরবৃত্তীয় বিভিন্ন কোষের পরিবর্তন, পরিবর্ধন ঘটিয়ে শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে প্রভাবিত করে এবং ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায়। ডিজেনারেটিভ রোগে অনেক অবক্ষয়জনিত উপসর্গ বিদ্যমান যা মূলত শরীরের বার্ধক্যজনিত রোগের সাথে সম্পর্কিত। নিচে ডিজেনারেটিভ রোগ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হলো:
- এই প্রকৃতির রোগের অন্যতম উদাহরণ হলো আলজেইমার ডিজিজ যা মূলত মানবদেহের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কোষগুলোকে নিস্ক্রিয় করে ফেলে।
- এর ফলে রোগীর মধ্যে সাম্প্রতিক ঘটনা মনে রাখতে অসুবিধা, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা, আচরণগত সমস্যা, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়ার মত উপসর্গগুলো দেখা দিয়ে থাকে এবং একটা পর্যায়ে শারীরিক ক্রিয়াকলাপ সম্পূর্ণভাবে নিস্ক্রিয় হয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়।
- এ জাতীয় রোগ শরীরের রক্তের সংবহনতন্ত্রকে প্রভাবিত করে হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিস এর মত আমৃত্যু অনিরায়মযোগ্য রোগের সৃষ্টি করে যার কুফল সম্পর্কে কমবেশি সবারই জানা।
- এছাড়াও এ জাতীয় রোগ শরীরের বিভিন্ন টিস্যু বা অঙ্গকে প্রভাবিত করে। এক্ষেত্রে দেহের বিভিন্ন টিস্যুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে মরনব্যাধি ক্যান্সারের সূত্রপাত ঘটে।
কে এই প্রিটিকিন?
প্রাচীন ও আধুনিককালের সমস্ত ভ্রান্ত ধারণা দূর করে সারা আমেরিকা জুড়ে খাদ্যবিধি ও স্বাস্থ্য নিয়ে রক্তপাতহীন বিপ্লব ঘটিয়েছেন এই প্রিটিকিন। প্রিটিকিন এর পূর্ণনাম Nathan Pritikin (নাথান প্রিটিকিন)। তিনি ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট আমেরিকার শিকাগোতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তৎকালীন আমেরিকার একজন বিখ্যাত উদ্ভাবক, প্রকৌশলী ও গবেষক ছিলেন। তবে তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিত পেয়েছেন একজন পুষ্টিবিদ হিসেবে। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল নিরোগ দীর্ঘায়ু জীবনযাপন।
বিশ্বখ্যাত এই পুষ্টিবিদ ও দীর্ঘায়ু গবেষক ১৯৮৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার আলবানি মেডিকেল সেন্টারে আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পূর্বেও তিনি সম্পূর্ণ সক্রিয় ছিলেন এবং মৃত্যুর পর পরীক্ষায় দেখা যায় তাঁর পাম্পিং ফাংশনও সম্পূর্ণ সুস্থ ও সঠিক মাত্রায় ছিল।
হৃদরোগ থেকে বাঁচার প্রাকৃতিক উপায় প্রিটিকিন প্রোগ্রাম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাথান প্রিটিকিন আমেরিকার পক্ষ থেকে যুদ্ধাবস্থায় মানসিক চাপের ফলে জনগণের স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে গবেষণায় লিপ্ত ছিলেন। তখন অবিরাম বোমা বর্ষণের দুঃসহ মানসিক চাপের ফলেও যুদ্ধপীড়িত মানুষের মধ্যে হৃদরোগ এবং অন্যান্য ডিজেনারেটিভ রোগের হার অদ্ভুতভাবে কম ছিল। তখনও তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেননি যে, যুদ্ধকালীন খাদ্য নিয়ন্ত্রণের ফলেই রোগ আক্রমণের হার কমে আসছে। তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন যখন নিজে অসুস্থ হয়েছেন এবং নিজের ওপর খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণের বাস্তব প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।
যুদ্ধকালীন সময়ে অনিয়ম ও অতিরিক্ত কর্মব্যস্থতার ফলে মাত্র ৪২ বছর বয়সে যখন তিনি নিজেই হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন তখন তাঁর শরীর একেবারেই ভেঙ্গে পড়ে। তাঁর স্বাস্থ্যের এতটাই অবনতি হলো যে, মাত্র কয়েক ফুটও হাঁটাচলা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। চিকিৎসকের পরামর্শে বেশ কিছুদিন বিশ্রামের পর তিনি অনুভব করলেন এই অবস্থায় তাঁর পক্ষে দীর্ঘদিন জীবনধারণ করা সম্ভব নয়। তাই তিনি প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি ছেড়ে শুরু করলেন নতুন কোনো পদ্ধতির অনুসন্ধান।
সেসময় উন্নত দেশগুলোতে হৃদরোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে খাদ্য ও দেহচর্চার ফলাফল নিয়ে পশুদের ওপর শুরু হয়েছে নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। প্রিটিকিনও সেই সময়ের কয়েকটি পর্যবেক্ষণ ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের আলোকে তাঁর নিজ চিকিৎসার চিন্তাধারার ভিত্তি করেছেন খাদ্য ও দেহচর্চার উপর। প্রথমত, তিনি দেখলেন যে, প্রকৃতির দেওয়া স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণকারী আদিম অধিবাসীদের মধ্যে হৃদরোগ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল। দ্বিতীয়ত, তাঁর নিজ গবেষণার ফল, যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থায় হৃদরোগের প্রাদুর্ভাব অভাবিত ভাবে কমে গেছে।
এরই মধ্যে বৈজ্ঞানিকরাও গবেষণাগারে প্রমাণ করেছেন যে, পশুদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র আহার্যের পরিবর্তন করে হৃদরোগ নিরাময় করা সম্ভব। তারা এটাও প্রমাণ করেছেন যে, সমস্ত রক্তবাহী ধমনী বন্ধ হয়ে গেলেও নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস ও দেহচর্চার ফলে শরীরে নতুন রক্ত সংবহনের ব্যবস্থা করাও সম্ভব। তারপরই তিনি মনস্থির করলেন আধুনিক সকল চিকিৎসা বাদ দিয়ে আদিম মানুষের ন্যায় প্রকৃতি প্রদত্ত খাদ্য উপাদানের সমন্বয়ে খাদ্যাভ্যাস ও নিয়ন্ত্রিত দেহচর্চাই হবে তাঁর চিকিৎসার মূল ভিত্তি।
প্রিটিকিন ঠিক করলেন যেহেতু হৃদরোগের সাথে সন্দেহাতীতভাবে অতিমাত্রার কোলেস্টেরল জড়িত তাই তাঁর প্রথম লক্ষ্যই ছিল অতিমাত্রার কোলেস্টেরল স্বাভাবিক মাত্রায় নিয়ে আসা। তারপর তিনি যথেষ্ট সতর্কতার সাথে ডিম, চর্বি, মাংস, মাখন প্রভৃতি কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ সকল খাদ্য বর্জন করে পুরোপুরি প্রকৃতিজাত স্বাভাবিক খাদ্য যেমন- খাদ্যশস্য, শাক-সবজি ও ফলমূল খেতে শুরু করলেন।
শুরু করলেন দু’সপ্তাহ অন্তর অন্তর রক্তের বিভিন্ন উপাদানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। প্রথম ১৮ মাসে কোনো রকম শারীরিক অবনতি ছাড়াই তাঁর কোলেস্টেরল এর মাত্রা নেমে এলো 300mg থেকে 160mg তে। একই রকম খাদ্য গ্রহণ করে পরবর্তী ১২ মাসের মধ্যে আশ্চর্যভাবে কোলেস্টেরল এর মাত্রা নেমে দাঁড়াল 100mg তে। কোলেস্টেরলের এমন সন্তোষজনক মাত্রা সচরাচর একজন মধ্যবয়স্ক স্বাস্থ্যবান ব্যক্তির ক্ষেত্রেও দেখা যায় না।
পরবর্তী ধাপে তিনি শুরু করলেন খুব সন্তর্পণে অল্প অল্প চলাফেরা এবং ধীরে ধীরে চলাফেরার মাত্রা বাড়াতে লাগলেন। এইভাবে যখন তিনি দৈনিক ২ মাইল করে হাঁটতে পারছিলেন তখন তিনি ইসিজি করে দেখতে পেলেন তাঁর হার্টের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। এরপর থেকে তিনি প্রতিদিন ৪ মাইল করে হাটতে থাকলেন এবং তখনও তাঁর কোনো প্রকার শারীরিক সমস্যা হচ্ছিল না। সবশেষে যখন তিনি প্রতিদিন ৬-৭ মাইল করে হাঁটতে এবং দৌঁড়াতে সক্ষম হলেন তখন চিকিৎসকরা তাঁর হার্টের যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন তিনি সম্পূর্ণরূপে হৃদরোগমুক্ত।
এভাবে নিজের ওপর পরীক্ষা শেষে তিনি সর্বপ্রথম লস এনজেলেস-এর ভি এ হাসপাতালে হৃদরোগীদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। সেখানে তিনি চালু করেন তাঁর নিজের ওপর প্রয়োগকৃত ‘প্রিটিকিন ডায়েট’ এবং নির্ধারিত দেহচর্চা ‘রোভিং’ এর সমন্বয়ে ‘প্রিটিকিন প্রোগ্রাম’। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে অভাবনীয় সফলতার পর তিনি বিশিষ্ট কিছু রোগীর ওপরও একই পন্থা অবলম্বন করে সফল হলে তাঁর এই ‘প্রিটিকিন প্রোগ্রাম’ এর সার্থকতা সম্পর্কে তিনি নিঃসন্দেহে নিশ্চিত হন।
‘প্রিটিকিন প্রোগ্রাম’ গবেষণার ব্যাপক বাস্তব প্রয়োগের জন্য তিনি সান্টা মনিকায় (ক্যালিফোর্নিয়া) "Pritikin Longevity Center" নামক গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন। এই গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার ৫-৬ বছর পরই প্রিটিকিন প্রোগ্রাম অনুসরণ করে নানা ধরনের ডিজেনারেটিভ রোগে আক্রান্ত হাজার হাজার মানুষের চিকিৎসায়ও অবিশ্বাস্য সফলতা আসে। নাথান প্রিটিকিন আশ্চার্যজনকভাবে প্রমাণ করেছেন যে, শুধুমাত্র হৃদরোগই নয়, ‘প্রিটিকিন প্রোগ্রাম’ যেকোনো ডিজেনারেটিভ রোগের জন্য কার্যকরী পদ্ধতি।
হৃদরোগে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীই আমৃত্যু বিভিন্ন ওষুধের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। কিন্তু উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে নিশ্চিতভাবে প্রতিয়মান যে, সুনির্দিষ্ট খাদ্যাভ্যাস ও দেহচর্চার মাধ্যমে হৃদরোগ চিরদিনের জন্য নির্মূল করা সম্ভব। আর সুনির্দিষ্ট খাদ্যাভ্যাস ও দেহচর্চার জন্য বিখ্যাত নিউট্রিসনিস্ট নাথান প্রিটিকিন কর্তৃক আবিস্কৃত ও একাধিকবার পরীক্ষিত ‘প্রিটিকিন প্রোগ্রাম’ সর্বোত্তম কার্যকরী পদ্ধতি।
হার্ট অ্যাটাক থেকে বাচার উপায় প্রিটিকিন প্রোগ্রামের বৈধতা
নাথান প্রিটিকিন এর গবেষণাগার "Pritikin Longevity Center" থেকে অসংখ্য সাধারণ রোগ ছাড়াও আনুমানিক বিশটি প্রধান রোগের ক্ষেত্রে আনে সার্থক নিরাময়। লন্জিভিটি সেন্টারে প্রিটিকিন প্রোগ্রামের এই সাফল্যের কথা প্রথম দিকে মানুষের মুখে মুখে ছড়ালেও, পরবর্তীতে নানা পত্র-পত্রিকায়, রেডিও-টেলিভিশন প্রভৃতির মাধ্যমে ক্রমাগত প্রচারিত হতে থাকে এবং এই ‘প্রিটিকিন প্রোগ্রাম’ নাটকীয়ভাবে প্রভাবিত করে পাশ্চাত্য জীবন-যাপন পদ্ধতি।
আহারবিধি ও দেহচর্চার মাধ্যমে নিরোগ দীর্ঘায়ু বিষয়ক গবেষণাকালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া কলেজ অব পেডিয়াট্রিক মেডিসিনের পুষ্টিতত্ত্ব গবেষণা বিভাগের একজন বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ছিলেন। এরপর গবেষণার বাস্তব প্রয়োগে অভূতপূর্ব সফলতার ফলশ্রুতিতে ১৯৭৫ সালে তিনি আমন্ত্রিত হন আমেরিকার ‘কংগ্রেস অব রিহ্যাবিলিটেশন’ এবং ‘আমেরিকান একাডেমি অব ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ‘ এর বিভিন্ন বার্ষিক সম্মেলনে।
সেখানে বিশ্বখ্যাত বিশেষজ্ঞদের নিকট তিনি উপস্থাপন করেন তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং সে সবের সাফল্য সম্পর্কে নানা তথ্য ও বিবরণ। নাথান প্রিটিকিনের এই প্রিটিকিন পদ্ধতি বা 'Pritikin Programme' উক্ত সম্মেলনগুলিতে বিখ্যাত বিশেষজ্ঞদের বিপুল সমর্থন লাভ করে এবং ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় পাশ্চাত্য জুড়ে। একটা সময় মানসিক চাপকেই হৃদরোগের প্রধান কারণ হিসেবে গণ্য করা হতো। কিন্তু নাথান প্রিটিকিন প্রমাণ করেছিলেন হৃদরোগের জন্য মানসিক চাপ দায়ী নয়, তবে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর মানসিক চাপ উক্ত রোগীর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
তৎকালীন ব্যাধিগ্রস্ত অসংখ্য মানুষকে তিনি অতি অল্প সময়ে আশ্চর্যজনকভাবে রোগমুক্ত করেছেন। শুধু আমেরিকা নয়, ইউরোপের বিভিন্ন উন্নত দেশে এবং অস্ট্রেলিয়ায় মানুষের কাছে খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি উন্মোচন করেছেন এক নতুন দিগন্ত।
হার্ট সুস্থ রাখতে যা খাবেন
প্রিটিকিন ডায়েটই হলো সর্বপ্রকার হৃদরোগ, হাই ব্লাডপ্রেশার, ডায়াবেটিস, আরথ্রাইটিস, বক্ষ ও মলাশয়ের ক্যানসার প্রভৃতি ডিজেনারেটিভ তথা বিপাকীয় রোগমুক্ত দীর্ঘজীবনের চাবিকাঠি। যারা প্রিটিকিন প্রোগ্রাম থেকে সর্বাধিক ও সর্বাঙ্গিন সুফল পেতে চান এবং পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সেও তারুণ্য ধরে রাখতে চান তাদের আজীবন অবিচলিতভাবে গভীর বিশ্বাস ও নিষ্ঠার সাথে এই ডায়েটই অনুসরণ করতে হবে।
প্রিটিকিন প্রোগ্রাম অনুমোদিত যেকোনো ডিজেনারেটিভ রোগসহ প্রাথমিক পর্যায়ে আছে এমন হৃদরোগী এবং নিরোগী দীর্ঘ তারুণ্য প্রত্যাশীদের জন্য নিম্নলিখিত খাবার তালিকাটি একাধিক গবেষণায় পরিক্ষীত এবং অত্যন্ত কার্যকরী:
খাবারের নাম |
খাওয়ার নিয়ম ও পরিমাণ |
বিধিনিষেধ |
ছোটমাছ, মাংস ও অন্যান্য |
|
|
ডিম |
|
|
দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য |
|
|
ফ্যাট ও তেল |
- |
|
বাদাম ও তৈলবীজ |
|
|
শস্য ও শস্যজাত খাদ্য |
|
|
ডাল ও সমজাতীয় খাদ্য |
|
|
শাক ও সব্জি |
|
|
ফল ও ফলজাত খাদ্য |
|
|
চিনি ও চিনিযুক্ত সর্বপ্রকার খাদ্য |
- |
|
সবরকম লবণ |
|
|
কনডিমেন্টস (আচার, চাটনি, কাসুন্দি), সস্ প্রভৃতি |
|
|
স্ন্যাকস ও ডেজার্ট |
|
|
পানীয় |
|
|
মুখমুদ্ধি ও ধূমপান প্রভৃতি |
|
|
প্রয়োজনীয় সতর্কতা:
|
তারুণ্য ধরে রাখতে কি খাওয়া উচিত
অল্প বয়সেই বার্ধক্য নিয়ে আসে বিভিন্ন ডিজেনারেটি রোগ। আর এসব ডিজেনারেটিভ রোগের সূত্রপাতই ঘটে বিকৃত কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাদ্যাভ্যাস। তাই নিরোগ দীর্ঘ তারুণ্য ধরে রাখতে কি খাওয়া উচিত এবং কি খাওয়া উচিত নয় এই প্রশ্নের উত্তর ইতঃপূর্বে উপরোক্ত ডায়েট চার্টে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
তবে যথাযথ পুষ্টি এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য খাদ্য-সামগ্রী নির্বাচনের সময় নিশ্চয়ই খাদ্যের মধ্যে প্রয়োজনীয় ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যামাইনো এসিডের পরিমাণ ঠিক আছে কিনা তা নিশ্চিত হয়ে নিবেন। তবে এ বিষয়ে বিশেষ কোনো চিন্তার কারণ নেই। বিভিন্ন খাদ্য উপাদানের যথাযথ ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য প্রিটিকিন প্রোগ্রাম অনুসারীকে নিম্নোক্ত নির্দেশনাগুলো মেনে চলতে হবে।
- প্রতিদিন যেকোনো ২ ধরনের খাদ্যশস্য খেতে হবে। অর্থাৎ শুধু ভাত নয়, ভাত ও রুটি দুটোই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে।
- প্রতিদিন দুই বা ততোধিক বার কাঁচা বা অর্ধসিদ্ধ শাক-সবজির স্যালাদ এবং রান্না করা সবুজ ও হলুদ সবজি খেতে হবে। এক্ষেত্রে আলু খাওয়ার সময় অবশ্যই খোসা ছড়িয়ে খেতে হবে।
- প্রত্যহ একটুকরো লেবু জাতীয় ফল এবং অন্তত ২-৩ টুকরো যে কোন তাজা ফল খেতে হবে।
- বিন, মটর, কড়াইশুঁটি সপ্তাহে তিনদিন খেতে হবে আর যদি পছন্দ না হয় তাহলে অন্তত একদিন খেতে হবে।
- ভিটামিন বি-১২ এর প্রয়োজন পূরণের জন্য স্বল্প ফ্যাট-যুক্ত মাছ, মুরগি বা মাংস রোজ ৩০ গ্রাম খাবেন তবে কোন ক্রমেই পুরো সপ্তাহে মোট ৬৮০ গ্রামের বেশি খাওয়া যাবে না।
- মাছ-মাংস না খেতে পারলে প্রতিদিন ৪৫০ গ্রাম মাখনতোলা দুধ এবং রান্না করা ডাল ২৪৪ গ্রাম খেতে হবে।
- কেউ পুরোপুরি ভেজিটেরিয়ান হলে এবং দুধও না খেতে পারলে তাকে অবশ্যই সপ্তাহে ১টা ভিটামিন বি-১২ ট্যাবলেট খেতে হবে।
- কারো যদি স্বাভাবিভাবে কোষ্ঠ পরিস্কার না হয় তারা প্রিটিকিন ডায়েট গ্রহণের শুরুতে ১ চা-চামচ এবং কয়েকদিন পর থেকে ২ চা-চামচ আটার ভূষি প্রতিদিন তরকারি কিংবা স্যুপের সাথে মিশিয়ে খেতে হবে।
- যদিও ঠিকমত নিয়ম মেনে প্রিটিকিন ডায়েট খেলে কোষ্ঠকাঠিন্যের পুরনো রোগীরও সামান্যতম অসুবিধা থাকার কোনো সম্ভাবনা থাকে না।
- প্রধান খাদ্য গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ে কিছুতেই ক্ষুধার্ত থাকা যাবে না। সে সময় ২-৩ টুকরো তাজা ফল বা এক বাটি স্যুপ অথবা খানিকটা কাঁচা সবজির সালাদ অবশ্যই খেয়ে নিতে হবে।
- ওজন বা মেদ কমিয়ে ফেলতে চাইলে প্রিটিকিন অনুসারীরা শাক, সিদ্ধ সবজি এবং ফলমূল বেশি করে খেতে হবে।
- অনুরোপভাবে কারো ওজন বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে শাক, সবজি ও ফলমূলের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে তুলনামূলক বেশি করে ভাত, রুটি ও বিভিন্ন ডাল জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে।
প্রয়োজনীয় সতর্কতা:
প্রিটিকিন ডায়েট শুরু করার অতি অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকেরই একটা নতুন প্রাণশক্তি, নতুন উদ্দীপনা, একটা সুস্বাস্থ্যের স্বাদ অনুভব এবং উপভোগ করেন। কিন্তু এর মধ্যেই আবার কেউ কেউ পেট ফাঁপা বা পেটে গ্যাস নিয়ে অস্বস্তি ভোগ করেন। সাধারণত এ সমস্যাটা একেবারেই স্বল্পস্থায়ী তবে কারো কারো ক্ষেত্রে এই অস্বস্তি কয়েকমাস চলতে পারে।
যাদের পেট ফাঁপা চলতেই থাকে তাদের অস্বস্থি দূর করার জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো নিতে পারেন:
- সিম, মটর, তুষ/ভূষি প্রভৃতি ৯৫টি ক্ষেত্রে পেট ফাঁপার জন্য দায়ী থাকে। এক্ষেত্রে যাদের কোষ্ঠকাঠিন্য আছে তাঁরা তুষ/ভূষি অবশ্যই খাবেন কিন্তু যাদের কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো কোনো সমস্যা নেই তাদের জন্য শুরুতেই এগুলি খাওয়া নিষ্প্রোয়াজন। কিছুদিন প্রিটিকিন ডায়েট অনুসরণ করার পর শরীর সয়ে নিলে ধীরে ধীরে এগুলো খাওয়া শুরু করবেন।
- অল্প-সিদ্ধ-করা সবজি, কাঁচা সব্জির চেয়ে হজম করা সহজ। তাই পেটে গ্যাসের সমস্যা দেখা দিলে প্রথম দিকে অল্প সিদ্ধ করা সবজি খাবেন। তারপর ধীরে ধীরে কাঁচা সবজি খাওয়া শুরু করবেন। যাদের গ্যাসের সমস্যা দেখা দিবে তারা গ্যাসের সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ফুলকপি ও বাধাকপি না খাওয়াই উত্তম। কারণ এ জাতীয় সবজিতে পেটে গ্যাস হওয়ার প্রবণতা অনেকাংশেই বেশি।
- অতিরিক্ত খাওয়াও অনেক সময় পেট ফাঁপার কারণ হতে পারে। তাই এক বৈঠকে পেট-ভরে খাওয়া বাদ দিতে হবে। যারা সারাদিন বারে বারে অল্প অল্প করে খান তাদের সাধারণত গ্যাসের প্রবণতা একেবারেই কম দেখা যায়। তাই দীর্ঘক্ষণ অভুক্ত না থেকে প্রধান খাবারের বিরতির মাঝে অল্প অল্প পরিমাণে ডায়েটে উল্লেখিত অন্যান্য খাবারও খেতে পারেন।
সর্বোপরি প্রিটিকিন ডায়েটের ফলে গ্যাসের অস্বস্তিতে ভুগলে উপরের নির্দেশনাগুলো অনুসরণপূর্বক দ্রুত সেটা সারিয়ে ফেলতে হবে। মনে রাখেতে হবে, প্রিটিকিন ডায়েটে যে অনন্য সুস্থতা, নিরোগ দীর্ঘ যৌবণ, অপূর্ব আনন্দ এবং পর্যাপ্ত প্রাণশক্তির যে আশ্বাস আছে সেই তুলনায় এই ক্ষণস্থায়ী অস্বস্থি ভোগ কিছুই নয়।
তারুণ্য ধরে রাখার ব্যায়াম
স্বাস্থ্যবিদরা বলেন, ব্যায়াম তথা শরীচর্চা দীর্ঘজীবন লাভে সহায়তা করে। এ সম্পর্কে আজপর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তা থেকে বলা যায় যে, প্রিটিকিন ডায়েটের সাথে শরীরচর্চা যুক্ত হলে জীবনের চেহারাটাই পাল্টে যায়। প্রিটিকিন অনুসারী ব্যক্তির দেহে একটা নতুন সুস্থতাবোধ আসে এবং নতুন জীবন উপভোগ করতে শুরু করে। এই রোগমুক্ত নতুন জীবন মধ্যবয়সেও তারুণ্যের প্রাণচঞ্চলতা ফিরিয়ে দিয়ে দীর্ঘ তারুণ্য সাধ বৃদ্ধি করে।
প্রিটিকিন প্রোগ্রামে ডায়েটের সঙ্গে শরীরচর্চা (রোভিং) যুক্ত হলে নিরোগ দীর্ঘ তারুণ্য লাভের সম্ভাবনা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে। শরীরচর্চা (রোভিং) এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটানা বেশ কিছুক্ষণ হাঁটা, জগিং করা এবং সম্ভব হলে দৌড়ানো। এই ধরনের শরীরচর্চাকে বলা হয় ‘আইসোটোনিক’ বা অ্যারোবিক ব্যায়াম। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ব্যায়মই শ্রেষ্ঠ, কেননা এ-ব্যায়ামে বাহু নাড়াতে হয়, পা চালাতে হয়, হৃদযন্ত্রের উন্নতি সাধন করে, দেহে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে এবং সর্বোপরি প্রিটিকিন ডায়েটে আহারকৃত খাদ্য খুব সহজেই হজম হয়ে পরিপাক ক্রিয়া সম্পাদন করে।
আর এক ধরনর জনপ্রিয় ব্যায়ম হচ্ছে ‘আইসোমেট্রিক’ যা লিফটিং বা ভারী ওজন তোলার মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। এ জাতীয় ব্যায়ামে সর্বাঙ্গে দৈহিক নড়াচড়ার কোনা সুযোগ নেই। এ ব্যায়াম হৃদযন্ত্রকে সুস্থ থাকতে বা সবল রাখতে তেমন কোনো কার্যকরী ভূমিকা রাখে না। উল্টো এতে হৃদযন্ত্রের উপর চাপ বাড়ে এবং রক্ত চাপ বাড়ে। সর্বোপরি এ ব্যায়ামের সাথে প্রিটিকিন ডায়েটের কোনো সামঞ্জস্য নেই।
“Who’s Who in American Sports” গ্রন্থে অ্যাথলেটদের গড় আয়ুস্কাল নিয়ে একটি সমীক্ষার রিপোর্টে বলা হয়েছে- একজন ফুটবল খেলোয়ারের গড় আয়ু ৫৭ বছর, বক্সারের গড় আয়ু ৬১ বছর, বেসবল খেলোয়াড়ের গড় আয়ু ৬৪ বছর এবং ট্র্যাক রানারদের গড় আয়ু ৭১ বছর। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ফুটবল খেলোয়াড়দের মধ্যে ৫০ বছরের বেশি আয়ু পেয়েছেন শতকরা ৬৫ জন, অন্যদিকে রানারদের মধ্যে ৫০ বছরের বেশি গড় আয়ু পেয়েছেন শতকরা ৮৭ জন। এজন্যই দৌড়ানো একটি নিখুঁত অ্যারোবিক ব্যায়াম।
বস্তুত নানারকম খেলাধুলার উদ্ভাবনের ফলে জগিং বা দৌড়ানোর মতো প্রভৃতি অ্যারোবিক ব্যায়াম এর আনন্দ মানুষ ভুলতে বসেছে। অন্যান্য ব্যায়াম বা খেলাধুলার চেয়ে রোভিং কিংবা দৌড়ানোর ফলে শরীরে নিম্নলিখিত কার্যগুলো সম্পাদিত হয়:
- শরীরের রক্ত চলাচল ঠিক রাখে।
- অস্থিসমূহকে দূর্বল হতে দেয় না।
- দেহের সঠিক ওজন বজায় রাখে।
- বার্ধক্য নিয়ন্ত্রণ করে এবং দীর্ঘ তারুণ্য নিশ্চিত করে।
- বাড়তি চর্বি তথা মেদভার কমিয়ে দেয়।
- হৃদরোগ নিবারণ করে।
- ইউরিক এসিডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে বাতব্যাধি নিবারণ করে।
- হৃদযন্ত্রকে আরও বেশি কর্মক্ষম করে মস্তিস্কের রক্ত-সংবহন ও তার কার্যকারিতা বাড়িয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের সামগ্রিক উন্নতি সাধন করে।
- দেহের অযাচিত ব্যথা বেদনা কমিয়ে দেয়।
- শুদ্ধ রক্তের প্রভাবে শরীরের লাবণ্য ফিরেয়ে আনে, শরীর আরও বেশি শক্তিশালী ও তারুণ্যময় হয়ে উঠে।
- মনের বিষন্নতা ও দুর্ভাবনা দূর করে।
- অনিদ্রা দূর করে।
- মাংসপেশীগুলিতে স্বাভাবিকভাবে শক্তি প্রবাহিত করে দেহের সুস্থতা ও কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
- ভালোভাবে সঠিক নিয়মে রোভিং (শরীরচর্চা) করলে দেহ তৈরি করতে পারে সাধারণের চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণ গ্লাইকোজেন যা অ্যাথলেটদের প্রধান মূলধন।
- এছাড়া গ্লাইকোজেনই দেহের সহিষ্ণুতা ও স্ট্যামিনা বৃদ্ধি করে যা যৌবনের প্রধান হাতিয়ার।
নিরোগ দীর্ঘজীবন লাভের জন্য এবং তারুণ্যের স্ফূর্তি ও আনন্দ বেশি বয়সেও অব্যাহত রাখার জন্য নাথান প্রিটিকিন এর রোভিং প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী পা বাড়িয়ে হাঁটতে শুরু করুন এবং হাঁটতে থাকুন। যাদের অনেকদিন ধরে হাঁটার অভ্যাস নেই তারা শুরুর দিকে অল্প করে ধীরে ধীরে হাটুন। এভাবে ৩ দিন হাটার পর ৪র্থ দিন থেকে দূরত্বটা ১০% বাড়িয়ে দিন। এরও ৪ দিন পর আরও ১০% বাড়ান। এভাবে পর্যায়ক্রমে বাড়াতে থাকলে ৪০ দিন পর প্রথম দিনের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হাঁটার অভ্যাস তৈরি হয়ে যাবে।
হাঁটার ব্যাপারে কত দ্রুত হাঁটলেন সেটা গৌণ বিষয়, মুখ্য বিষয় হলো কতটা দূরত্ব হাঁটলেন। প্রিটিকিন প্রোগ্রামের নিয়মানুযায়ী প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট করে দু’বার সর্বমোট ১ ঘণ্টা হাটার অভ্যাস করতে হবে। এভাবে ৪০ দিন হাঁটার পর অভ্যস্ত হয়ে গেলে হাটার গতি একটু বাড়িয়ে দিতে পারেন। গায়ের জোরে কখনোই হাঁটবেন না, ঠিক ততটা দ্রুত হাঁটবেন যতটা আপনার শরীর স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করতে পারে। এভাবেই শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কর্মক্ষমতার উন্নতি হাঁটা কিংবা জগিং এর মাধ্যমে সাধিত হয়।
দীর্ঘ তারুণ্য ধরে রাখার প্রাকৃতিক উপায়
দীর্ঘ তারুণ্য ধরে রাখার পূর্বশর্তই হলো সকল প্রকার ডিজেনারেটিভ রোগ থেকে নিজেকে সুরক্ষা দেওয়া। প্রিটিকিন এর ভাষ্যমতে না খেলে কিংবা কম খেলে হয়তো অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগবে কিংবা অপুষ্টির কারণে কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারে যা চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময়যোগ্য কিন্তু বেশি খেলে কিংবা অস্বাস্থ্যকর খাবার খেলে জীবনাশী ডিজেনারেটিভ রোগে আক্রান্ত হয়, যার নির্মূলযোগ্য কোনো চিকিৎসা নেই।
ডিজেনারেটিভ রোগগুলো মূলত দীর্ঘ দিনের খাদ্যাভ্যাসের ফলে ধীরে ধীরে শরীরের বাসা বাঁধে, দেহে বার্ধক্যের স্পষ্ট ছাপ তুলে ধরে এবং একটা পর্যায়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গকে নিস্ক্রিয় করে ফেলে। বিভিন্ন স্যোসাল মিডিয়ায় তথাকথিত অনেক নিউট্রিসনিস্ট চমকপ্রদ উপস্থাপনায় দীর্ঘ তারুণ্য ধরে রাখার নানাবিধ উপায় বলে থাকলেও প্রকৃত পক্ষে একাধিক গবেষণায় পরিক্ষীত এই প্রিটিকিন প্রোগ্রামই সবচেয়ে বেশি কার্যকরী।
প্রিটিকিন প্রোগ্রামের ডায়েট এবং রোভিং-ই (দেহচর্চা) নিরোগ দীর্ঘ তারুণ্য ধরে রাখার একমাত্র পরিক্ষীত পদ্ধতি। প্রিটিকিন প্রোগ্রাম শুরু করার পূর্বে নিজের ওজন, ব্লাড প্রেসার, কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইডস্-ইউরিক অ্যাসিড ইত্যাদির মাত্রা পরীক্ষা করিয়ে রাখুন। গভীর বিশ্বাস ও নিষ্ঠার সাথে এক মাস প্রিটিকিন প্রোগ্রাম অনুসরণ করলে দেহ-মনেতো অনুভব করবেনই, তবুও রক্তের উপরোল্লিখিত উপাদানগুলো পুনরায় পরীক্ষা করলে আপনার একাগ্রতার পুরস্কার সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবেন।
চেহারায় লাবণ্য ধরে রাখার উপায়
সতেজ ও লাবণ্যময়ী চেহারা ধরে রাখতে এখানেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে প্রিটিকিন প্রোগ্রামের ডায়েট চার্ট এবং দেহচর্চা। উপরোক্ত ডায়েট চার্ট অনুসরণ এবং শরীরচর্চার পাশাপাশি চেহারায় লাবণ্য ধরে রাখার উপায় হিসেবে ঘরোয়া পদ্ধতিতে তৈরী নিম্নোক্ত পন্থাগুলো খুবই কার্যকরী:
- অতিরিক্ত দুঃচিন্তার ফলে মুখমন্ডলের স্কিনে বাধ্যর্কের ছাপ, বলিরেখাসহ বিভিন্ন স্পট দেখা দিতে পারে। তাই সতেজ ও লাবণ্যময়ী চেহারা পেতে সবরকম দুঃশ্চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে।
- চেহারাকে সতেজ ও লাবন্যময় রাখতে শরীরকে পর্যাপ্ত পানি দিতে হবে। অর্থাৎ প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। পানি পান করার সঠিক নিয়ম হলো অল্প অল্প করে কিছুক্ষণ পর পর পান করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতি ঘণ্টায় ১ গ্লাস করে পানি পান করা যেতে পারে। একসাথে অনেক পানি পান করলে শরীর তা রাখতে পারে না এবং খুব দ্রুতই তা প্রস্রাবের সাথে বের হয়ে যায়, যার ফলে কিডনির উপরও চাপ পড়তে পারে।
- সতেজ স্কিনের জন্য কোলাজেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই লাবন্যময়ী চেহারার জন্য খাদ্যতালিকায় কোলাজেন সমৃদ্ধ খাবার একান্ত জরুরী। এক্ষেত্রে মাছ থেকে তৈরি কোলাজেন খুবই কার্যকরী।
- সতেজ ও লাবন্যময়ী চেহারার জন্য খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন কমপক্ষে একটি করে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার দেহের স্কিন ফ্রেস ও ব্রাইট করতে খুবই উপকারী উপাদান।
- এছাড়াও স্কিনে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ সিরাম ব্যবহার করা যেতে পারে।
- অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যুক্ত সকল প্রকার রঙিন খাবার বিশেষ করে, বিট, গাজর, টমেটো ইত্যাদি দৈনন্দিন খাদ্য তালিকা রাখতে হবে। চেহারার স্কিন গ্লো করার জন্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
- পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে হবে। ঘুম কম হলে উপরোল্লিখিত কোনো উপাদানই সঠিকভাবে কাজ করবে না। স্বভাবতই চেহারায় বার্ধকের ছাপ পড়ে যাবে। সাধারণত বয়স অনুযায়ী মানুষের ঘুমের সময়টা কম বেশি হতে পারে। তবে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে দৈনিক ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত।
- কথায় আছে যত্নে রত্ন মিলে। সতেজ স্কিন ও লাবন্যময়ী চেহারার জন্য যত্নের কোনো বিকল্প নেই। স্কিনের যত্নের জন্য কিছু নির্দিষ্ট সময় ফেসওয়াস করা যেতে পারে, বিশেষ করে বাহির থেকে আসার পর সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ফেসওয়াসটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে ক্যামিকেল সমৃদ্ধ ফেসওয়াস পরিহার করে প্রাকৃতিক উপায়ে ঘরে তৈরি ফেসপ্যাক দিয়ে স্কিনের যথাযথ যত্ন নিতে হবে। পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ বিভিন্ন খাদ্যউপাদান দিয়েও ফেসপ্যাক তৈরি করা যায় যা তথাকথিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ফেসওয়াস থেকে হাজারগুণ উত্তম।
- মাসে অন্তত ১-২ বার ডিপ ক্লিনজিং (স্ক্রাভ) করতে হবে। প্রাকৃতিক উপায়ে ঘরে বসেই চালের গুড়া, টকদেই এবং মধু দিয়ে এই উপাদানটি তৈরী করা যায় যা বাজারে প্রাপ্ত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরী অনেক নামীদামী ব্যান্ডের স্ক্রাভ থেকেও অধিক উত্তম। ক্লিনজিং করার সময় স্কিনকে ভালোভাবে ময়েশ্চার করতে হবে। ময়েশ্চারাইজার হিসেবে কমপ্রেসড কোকনাট অয়েল কিংবা এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ ওয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে।
- মনে রাখবেন স্কিন যত ময়েশ্চার থাকবে ঠিক ততটাই টানটান, সতেজ ও লাবন্যময় থাকবে আপনার চেহারা।
- সর্বোপরি বাসা থেকে বাহিরে গেলে কিংবা খোলা আকাশের নিচে রোধের মধ্যে কোন কাজ করতে হলে অবশ্যই সান্সক্রিম ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে UVA এবং UVB সমৃদ্ধ সান্সক্রিম অধিক কার্যকরী।
লেখকের মন্তব্য
নাথান প্রিটিকিন এর ‘প্রিটিকিন প্রোগ্রাম’ দীর্ঘ তারুণ্য ধরে রাখার প্রাকৃতিক উপায় হিসেবে পাশ্চাত্যে বহুল প্রচলিত। এছাড়াও আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। “তারুণ্য ধরে রাখতে কি খাওয়া উচিত এবং হৃদরোগীদের খাবার তালিকা” শীর্ষক আর্টিকেলে শিরোনোমের পাশাপাশি হৃদরোগ থেকে বাঁচার প্রাকৃতিক উপায়, হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচার উপায়, হৃদরোগীদের খাবার তালিকা, তারুণ্য ধরে রাখার উত্তম ব্যায়ম এবং চেহারায় লাবন্য ধরে রাখার উপায় সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য উৎস হতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো উপস্থাপনের সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি।
আশাকরি আর্টিকেলটি স্বাস্থ্যসচেতন প্রত্যেকের জন্য সহায়ক হবে। আর্টিকেলে কোনো প্রকার ভুলত্রুটি পরিলক্ষিত হলে কিংবা কোনো তথ্য সংযোজন, বিয়োজন কিংবা পরিমার্জনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে কমেন্টবক্সে আপনার সুচিন্তিত মতামত সাদরে গ্রহণযোগ্য। সেইসাথে আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হলে আপনার প্রিয়জন ও পরিচিত হৃদরোগীসহ যেকোনো ডিজেনারেটিভ রোগীদের নিকট শেয়ার করার জন্য অনুরোধ রইলো। আর্টিকেলটি প্রত্যহ নিয়মমাফিক অনুসরণের সুবিধার্থে আপনার ডিভাইসের ব্রাউজারে বুকমার্ক করে রাখতে পারেন যেন প্রয়োজনে সহজেই খুঁজে পেতে সুবিধা হয়।
তথ্যসূত্র: উকিপিডিয়া, বিবিসি, গ্রন্থসমূহ: "Live Longer Now: The First One Hundred Years of Your Life: The 2100 Program" By Grosset & Dunlap; "The Pritikin Program for Diet and Exercise" By Bantam. “বিনা ওষুধে রোগ নিরাময়: প্রিটিকিন প্রোগ্রাম” বাই চিন্ময় সেনগুপ্ত। সাক্ষাৎকার: স্কিন বিশেষজ্ঞ ড. ফারিয়াল হক, নিউট্রিসনিস্ট আয়শা সিদ্দিকা। |
আপনার সুচিন্তিত মতামত দিয়ে MrDorpon কে আরও সমৃদ্ধ করতে সহযোগিতা করুন। আপনার মতামতটি রিভিউর পর Published করা হবে।
comment url