গাভীর দুধ উৎপাদন কম বেশি হওয়ার কারণ এবং প্রতিরোধের উপায়
গাভীর দুধ উৎপাদন কম বেশি হওয়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হলো গাভীর জাত নির্বাচন। অনেকক্ষেত্রে উন্নত জাতের গাভী হতেও আশানুরূপ দুধ উৎপাদন সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে গাভীর দুধ বৃদ্ধির খাদ্য তালিকা অনুসরণ পূর্বক প্রাকৃতিক উপায়ে গাভীর দুধ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
দুগ্ধজাত খামারে গাভীর জাত নির্বাচনে ভুল করলে গাভীর দুধ উৎপাদন কম হওয়াটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে সুষম খাদ্য ব্যবস্থাপনায় গাভীর দুধ বৃদ্ধির খাদ্য তালিকা প্রণয়ন করে পরিমিত পরিমাণে খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে প্রাকৃতিক উপায়ে গাভীর দুধ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
ভূমিকা
দুগ্ধজাত খামার ব্যবস্থাপনায় সুনির্দিষ্ট কর্ম পরিকল্পনা ব্যতীত সফলতা অর্জন সম্ভব নয়। কেননা দুগ্ধজাত খামারে আয়ের মূল উৎসই হলো গাভীর দুধ যা প্রতিদিন দোহাতে হয়। বিভিন্ন কারণে কখনও কখনও গাভীর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ কম বেশি হয়ে থাকে। গাভীর দুধ উৎপাদন আশঙ্কজনকভাবে কমে গেলে খামার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তাই গাভীর দুধ উৎপাদনের কারণ সম্পর্কে অবগত হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে দুগ্ধজাত খামারের এই সমস্যা পরিত্রাণ করা সম্ভব।
দুগ্ধজাত খামারে দুধ উৎপাদনের পাশাপাশি দুধ সংরক্ষণ করাটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই কি কি কারণে দুধ নষ্ট হতে পারে সে সম্পর্কেও খামারীকে জ্ঞান আহোরণ করতে হবে। এছাড়াও ‘গাভীর দুধ উৎপাদন কম বেশি হওয়ার কারণ এবং প্রতিরোধের উপায়’ শিরোনামে রচিত এই আর্টিকেলে উপস্থাপন করা হয়েছে গর্ভবতী গাভী চেনার উপায়, প্রাকৃতিক উপায়ে গাভীর দুধ বৃদ্ধির কৌশল, গাভীর দুধ বৃদ্ধির খাদ্য তালিকা।
গর্ভবতী গাভী চেনার উপায় / গর্ভাবস্থা পরীক্ষা করা উপায়
গাভী প্রজনন করানোর তিন মাস পরেই গর্ভাবস্থা পরীক্ষা করতে হয়। বেশ কিছু পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক গাভীর গাভী গর্ভবতী হয়েছে কিনা তা নির্ণয় করা যায়। নিচে গাভীর গর্ভাবস্থা পরীক্ষা করার ক্যিছু পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো:
- প্রজনন করানোর তিন মাস পর পায়ু পথে হাত ঢুকিয়ে বাচ্চা অনুভব করে গর্ভধারণ নিশ্চিত হওয়া যায়।
- গর্ভাবস্থায় গাভী কখনও গরম হয় না। গাভীকে প্রজনন করানোর পর পরবর্তী নির্দিষ্ট সময়ে গাভী যদি পুনরায় গরম না হয় (হিটে না আসে) তাহলে বুঝতে হবে গাভী গর্ভ ধারণ করেছে।
- বেরিয়াম ক্লোরাইড সলুশন দিয়ে গাভীর গর্ভাবস্থা পরীক্ষা করা যায়।
- প্রজননের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি গাভী শান্ত হয়ে আসে এবং পরবর্তী ২১ দিন পর গাভী যদি আর গরম না হয় (হিটে না আসে) তাহলে বুঝতে হবে গাভী গর্ভবতী হয়েছে।
- গর্ভবতী গাভীর স্বাস্থ্য দিন দিন বাড়তে থাকে।
- দুধের গাভী হলে প্রজননের ৫-৬ মাস পর থেকে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ কমে যাবে।
- পাঁচ মাস পার হলে গর্ভবতী গাভীর বাচ্চার নড়াচড়া বুঝা যায়।
- ৬-৭ মাস পর থেকে গর্ভবতী গাভীর ওলান বড় হতে থাকবে।
- গর্ভাবস্থার শেষের দিকে গাভীর যোনিমুখ থেকে মিউকাস বেড় হতে দেখা যাবে।
- গাভীর দুধ বা রক্তে প্রজেস্টেনের পরিমাণ নির্ণয় করে গাভীর গর্ভাবস্থা পরীক্ষা করা যায়।
- আজকাল আল্ট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমেও গাভীর গর্ভাবস্থা নির্ণয় করা যায়।
গাভীর দুধ উৎপাদন কম বেশি হওয়ার কারণ
দুধ উৎপাদন প্রজাতি থেকে প্রজাতিতে ভিন্নরূপ হয়। ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির পশু ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ ও পুষ্টিমানের দুধ উৎপাদন করে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন জাতের গাভীর দুধ উৎপাদনের হার ও পুষ্টিমান ভিন্ন হয়ে থাকে। এমনকি একই জাতের ভিন্ন ভিন্ন গাভীর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ ও গুণগতমান এক হয় না।
বিভিন্ন কারণে গাভীর দুধের পরিমাণ ও মানের তারতম্য ঘটে। তবে বিশেষ কোনো রোগ-ব্যাধি ছাড়া গাভীর দুধ উৎপাদন কম বেশি হওয়ার কারণগুলো নিতান্তই স্বাভাবিক, যা থেকে একটু সতর্ক হলে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। নিচে গাভীর দুধ উৎপাদন কম বেশি হওয়ার কারণগুলো সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো:
- জাত: গাভীর দুগ্ধমান ও পরিমাণ উভয়ই জাতের ওপর নির্ভরশীল। গাভীর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ এবং দুধের উপাদান যেমন- চর্বি, আমিষ, খনিজ পদার্থ ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন জাতের গাভীতে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। বংশগত ক্ষমতা ও দক্ষতাই এর মূল কারণ। দেশী জাতের গাভীতে চর্বির পরিমাণ বেশী থাকে কিন্তু দুধ উৎপাদন ক্ষমতা নিতান্তই কম। উপমহাদেশীয় অন্যান্য জাতের গাভী যেমন- সিন্ধি, শাহিওয়াল, হরিয়ানা ইত্যাদি জাতের গাভীর দুধে চর্বির পরিমাণ বিদেশী জাতের হলস্টেন ফ্রিজিয়ান, জার্সি ইত্যাদি থেকে বেশি থাকে। কিন্তু হলস্টেন ফ্রিজিয়ান ও জার্সি গাভীর দুধের পরিমাণ উপমহাদেশীয় জাত সিন্ধি, শাহিওয়াল ও হরিয়ানা থেকে অনেক বেশি।
- গাভীর বয়স: গাভীর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ এবং দুধের উপাদান উভয়ের উপর গাভীর বয়স গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। গাভী প্রথম প্রসবে দুধ কম দেয়। ধীরে ধীরে দুধ উৎপাদনের হার বাড়তে থাকে এবং ৪র্থ প্রসবে সবচেয়ে বেশি দুধ দেয়। তারপর থেকে পুনরায় দুধ উৎপাদনের হার কমতে থাকে।
- খাদ্য: খাদ্য গাভীর দুধ উৎপাদন ও পুষ্টিগুণ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। গাভীকে অধিক পরিমাণ সুষম খাদ্য খাওয়ালে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি দুধের পুষ্টিগুণও বেশি থাকবে।স সাধারণত অতিরিক্ত দানাদার খাদ্য, বড়ি জাতীয় খাদ্য, অতিরিক্ত রসালো খাদ্য, অতিরিক্ত রসালো ঘাস, মিহিভাবে গুড়া করা হে ইত্যাদি খাওয়ালে দুধের চর্বির পরিমাণ কমে যায় এবং দুধের পরিমাণও কমে যেতে পারে।
- গাভীর দুধ দোহন: গাভীর দুধ দোহন বিশেষ করে দোহনকাল, দোহনের হার, দোহনের সময়, দুধ দোহন প্রক্রিয়া, দুধের বাঁট ইত্যাদি গাভীর দুধের পরিমাণ ও পুষ্টিমান উভয়কেই প্রভাবিত করে। গাভীর দুধ প্রদান আস্তে আস্তে ৫০ দিন পর্যন্ত বেড়ে সর্বোচ্চ হয়। তারপর আস্তে আস্তে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ পুনরায় কমতে থাকে। অনেকক্ষণ পর দুধ দোহন করলে ওলানে দুধের চাপ বেশি থাকে এবং দুধে চর্বির পরিমাণ বেশি পাওয়া যায়। তাই গাভীর দুধ প্রতিদিন ২-৩ বার নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর দুধ দোহানো উচিত। এতে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ বাড়তে পারে।
- দুগ্ধহীনকাল ও গাভীর শারীরিক অবস্থা: দুগ্ধহীনকালে বিশেষ করে গর্ভকালে এবং প্রসবকালে গাভীর শারীরিক অবস্থার উপর দুধ উৎপাদন ও পুষ্টিমান নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গাভী হতে বেশি দুধ পেতে হলে গর্ভকালে সুষ্ঠু পরিচর্যা ও সুষম খাদ্য সরবরাহ একান্ত প্রয়োজন। প্রসবের দু’মাস পূর্বে গাভীর দুধ দোহন অবশ্যই বন্ধ করে দিতে হবে। গর্ভকালের শেষের দিকে রক্তে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরণ নামক হরমোণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এ সময় দুধ দোহন করলে প্রসবের পর গাভী হতে আশানুরূপ দুধ উৎপাদনে নানারকম প্রতিবন্ধকতা দেখা দিতে পারে।
- গাভীর বাঁটের প্রভাব: সাধারণত গাভীর মোট দুধ উৎপাদনের ৪০% উলানের সম্মুখ অংশের বাঁট এবং ৬০% পিছনের অংশের বাট থেকে পাওয়া যায়। তাই, দুধ উৎপাদনের তারতম্যতা গাভীর ওলানের অংশের উপর নির্ভর করে।
- খামার ব্যবস্থাপনা: খামার ব্যবস্থাপনা, গাভী রক্ষণাবেক্ষণ ও বাসস্থান গাভীর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ ও মানের হ্রাস বৃদ্ধির জন্য অনেকাংশে দায়ী। তাই গাভী হতে আশানুরূপ দুধ পেতে গাভীর পারিপার্শ্বিক অবস্থা আরামদায়ক হওয়া উচিত। তাছাড়া দুধ দোহনের সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন না করলে অর্থাৎ দুধ দোহন ত্রুটিপূর্ণ হলে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ ও দুধের মান উভয়ই হ্রাস পেতে পারে।
- আবহাওয়া ও ঋতুর প্রভাব: প্রতিকুল আবহাওয়া দুধ উৎপাদনের জন্য ক্ষতিকর। শীতের মৌসুম গাভীর জন্য কষ্টদায়ক। এ মৌসুমে দুধের পরিমাণ কমে যায় কিন্তু দুধে চর্বির পরিমাণ বেশি থাকে। গ্রীষ্মকাল, বর্ষাকাল ও আর্দ্র আবহাওয়ায় গাভীর দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও দুধের গুণাগুণ কিছুটা হ্রাস পায়।
- গাভীর গরমে আসা (হিটে আসা): গাভী গরম হলে দুধ উৎপাদন কমে যায়। যদিও এটি অস্থায়ী। গাভীর ইস্ট্রাসের সময় দুধ উৎপাদনের হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়।
- শুষ্ককাল: গাভী স্বাভাবিকভাবে বাচ্চা প্রসবের পর ৭০-৯০ দিন (গড়ে ৮৫ দিন) পরে আবার গর্ভধারণ করতে পারে। ভালোমানের একটি গাভীর দুগ্ধদানকাল ৩০৫ দিন। পরবর্তী ৬০ দিন গাভীর শুষ্ককাল। শুষ্ক অবস্থায় থাকলে গাভী পুনরায় বাচ্চা প্রসবের জন্য এবং দুগ্ধ দানের জন্য উপযুক্ত হয়। এতে করে গাভীর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ পুনরায় আগের মত বৃদ্ধি পায়।
- বাচ্চা প্রদানের ব্যবধান: বাচ্চা প্রসবের ব্যবধান গাভীর দুধ উৎপাদনের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। দীর্ঘ বিরতিতে বাচ্চা প্রদানে গাভীর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। স্বল্প বিরতিতে গাভীর দুধ উৎপাদন হ্রাস পায়। তাই গাভী বাচ্চা প্রসবের পর ৬০-৯০ দিনের মধ্যে পুনরায় প্রজনন করাতে হয়। তবে কোনো ক্রমেই প্রসবের পর ৬০ দিনের পূর্বে গাভীকে প্রজনন দেওয়া উচিত নয়।
- হরমোনের প্রভাব: হরমোন গাভীর দুধ উৎপাদনের পরমাণ গুণাগুণের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। গাভীর থাইরয়েড গ্রন্থি অপসারণ করলে গাভীর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ ও মান উভয়ই নিকৃষ্ট হয়ে যায়।
- তাপমাত্রার প্রভাব: তাপমাত্রা গাভীর দুধ উৎপাদনের পরিমানের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। তাই অতিরিক্ত গরমের দিনে গাভীকে ঠান্ডা আবহাওয়ায় রাখতে পারলে গাভীর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
- গাভীর শারীরিক সুস্থতা: গাভীর শারীরিক সুস্থতা দুধ উৎপাদন ও উপাদানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাভী যেকোনো রোগে আক্রান্ত হলে কিংবা যেকোন অস্বাভাবিক অবস্থায় পতিত হলে দুধ উৎপাদন হ্রাস পাবে। গাভী ওলান প্রদাহ রোগে আক্রান্ত হলে দুধে ল্যাকটোজ ও চর্বির পরিমাণ কমে যায়।
- গাভীর বংশগত বৈশিষ্ট্য: দুগ্ধজাত গাভী বা বকনা বা বাছুর ক্রয়ের পূর্বে নথিভূক্ত রেকর্ড দেখে জেনে নিতে হবে পশুটির মায়ের শারীরিক গঠন কেমন ছিল। কারণ গাভী দুধ উৎপাদনে জাতের পাশাপাশি গাভীর বংশগত বেশিষ্ট্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বড় গাভী বেশি দুধ প্রদান করে। গাভী সাধারণত নিজ শরীরের ভরের ৮-১০ ভাগের বেশি দুধ প্রদান করে না।
- দুগ্ধ দানের স্থায়িত্বকাল: গাভীর দুগ্ধদানকাল নির্ভর করে গাভীটি প্রথম দুইমাসের মধ্যে সর্বোচ্চ কতটুকু দুধ দেয়। এর পর থেকে কিছু কিছু গাভী মাসপ্রতি দুগ্ধদান হ্রাস পায় ৬-৮ শতাংশ। কোন কোন ক্ষেত্রে হ্রাসের পরিমাণ ৮-১২ শতাংশ পর্যন্তও হতে পারে।
- পীড়ন: গাভীর দুগ্ধদানের উপর অতিরিক্ত চাপ বা পীড়ন দুগ্ধ উৎপাদনের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। যদি কোন গাভী দুগ্ধ উৎপাদনের জন্য নির্বাচন করা হয় তাহলে যেকোন ধরনের সামান্য পীড়ন গাভীর দুধ উৎপাদনে প্রভাব বিস্তার করে।
- দোহনকারীর প্রভাব: দুধ দোহনকারীর পরিবর্তনের ফলেও গাভীর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ কমে যায়। দোহনকারীর পরিবর্তন হলে তার দুধ দোহনের পদ্ধতিও পরিবর্তন হয় যা গাভীর জন্য বিরক্তির কারণ। আর দুধ দোহনের সময় গাভী বিরক্ত হলে দুধ উৎপাদন কমে যায়।
- রোগ: বিভিন্ন ধরনের গাভীর দুগ্ধ উৎপাদন কমিয়ে দেয়। রোগ হৃৎপিন্ডের স্পন্দনকে প্রভাবিত করে ফলে গাভীর দুগ্ধ গ্রন্থিতে রক্ত সঞ্চালনে ব্যাহত হয় এবং দুধ উৎপাদন কমে যায়।
উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো গাভীর দুধ উৎপাদন কম বেশি হওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণ। এছাড়াও আরও কারণ থাকতে পারে। কেননা গাভীর দুধ উৎপাদন কম বেশি হওয়ার কারণগুলো সাধারণত স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে সঠিক পরিচর্যা ও অভিজ্ঞ পশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এই সমস্যা থেকে প্ররিত্রাণ পাওয়া খুবই সহজ।
গাভীর দুধ বৃদ্ধির খাদ্য তালিকা
পশুর স্বাস্থ্য সংরক্ষণ, দৈহিক বৃদ্ধি, বাচ্চা ও দুধ উৎপাদন এবং প্রাত্যহিক কর্মক্ষমতার জন্য বিভিন্ন খাদ্য উপাদানের সমন্বয়ে পশুর জন্য সুষম খাদ্য তালিকা প্রস্তুত করা প্রয়োজন। বিশেষ করে দুগ্ধবতী গাভীর জন্য সুপরিকল্পিত সুষম খাদ্য প্রস্তুতপুর্বক যথাসময়ে সরবরাহ করা একান্ত প্রয়োজন। অন্যথায় গাভীর দুধ উৎপাদন কমে যায় এবং বাছুরের দৈহিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটে। গাভীর দুধ উৎপাদন কমে গেলে নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে গাভীকে খাদ্য সরবরাহ করলে গাভী হতে আশানুরূপ দুধ উৎপাদন সম্ভব।
প্রতিদিন প্রতিটি দুগ্ধবতী গাভীকে কাঁচা ঘাস ১৫-২০ কেজি, খড় ০৫ কেজি, দানাদার খাদ্য ০৩-০৮ কেজি এবং প্রচুর পরিমাণে পানি খাওয়ানো প্রয়োজন। উল্লেখ্য যে, একটি গাভীকে প্রতি ১৫ লিটার দুধের জন্য ৩ কেজি, পরের প্রতি ১ লিটার অতিরিক্ত দুধের জন্য ০.৫ কেজি হিসেবে সর্বোচ্চ ০৮ কেজি পর্যন্ত দানাদার খাদ্য খাওয়ানো যেতে পারে। নিচে গাভীর দুধ বৃদ্ধির ১০০ কেজি দানাদার খাদ্য তালিকা প্রস্তুত প্রণালী উপস্থাপন করা হলো:
ক্র. নং |
খাদ্য উপাদান |
পরিমাণ (কেজি) |
||
পশুসম্পদ কর্তৃক ফরমূলা |
বি.এল.আর.আই কর্তৃক ফরমূলা |
এ.টি.পি কর্তৃক ফরমূলা |
||
০১. | গমের ভূসি | ৪৬.০০ | ২৯.০০ | ৪০.০০ |
০২. | খৈল | ২০.০০ | ৪০.০০ | ২০.০০ |
০৩. | খেসারী ভাংগা | ২০.০০ | ৩০.০০ | ২৭.০০ |
০৪. | মাসকালাই ভাংগা | ১০.০০ | - | - |
০৫. | চাউলের কুড়া (তুষ ছাড়া) | - | - | ১০.০০ |
০৬. | খাদ্য লবণ | ০১.০০ | ০১.০০ | ০১.০০ |
০৭. | ভিটামিন প্রিমিক্স | ০৩.০০ | - | ০২.০০ |
মোট = | ১০০ | ১০০ | ১০০ |
প্রাকৃতিক উপায়ে গাভীর দুধ বৃদ্ধির কৌশল
গাভীর দুধ উৎপাদন কমে গেলে শুরুতেই ঔষধ প্রয়োগের পূর্বে প্রাকৃতিক উপায়ে গরুর দুধ বৃদ্ধির কৌশল অবলম্বন করে অনেকেই সফল হয়েছে যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত ও ফলপ্রসূ। এছাড়া ঔষুধ প্রয়োগ করে দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি করলে দুধের গুণগত মান নিয়ে কিছুটা হলেও প্রশ্ন থেকে যায় কিন্তু প্রাকৃতিক উপায়ে গাভীর দুধ বৃদ্ধির উপায় অবলম্বন করলে দুধের পুষ্টিগুণ অক্ষুন্ন থাকে। নিচে প্রাকৃতিক নিয়মে গাভীর দুধ বৃদ্ধির একটি কৌশল উপস্থাপন করা হলো:
উপকরণসমূহ:
- ০১ লিটার সরিষার তেল, আস্ত শুকনা হলুদ ও লাল চিনি বা আখের গুড়।
প্রস্তুত প্রণালী:
- প্রথমে একটি কড়াইয়ের মধ্যে ২৫০ গ্রাম সরিষার তেল ভালোভাবে গরম করে এর মধ্যে হলুদগুলো ভাজতে হবে।
- হলুদগুলো যখন খয়েরী কিংবা কালচে হলুদ রং হয়ে আসবে তখন এগুলো ছাকনির সাহায্যে কড়াই থেকে নামিয়ে নিতে হবে।
- তারপর হলুদে লেগে থাকা তেল ঝড়িয়ে ঝরঝরে করে নিতে হবে।
- তেলেভাজা হলুদগুলোকে তেল ঝড়িয়ে ঝরঝরে করে হামানদিস্তার সাহায্যে ভালোভাবে গুঁড়ো করে নিতে হবে।
- উক্ত হলুদের গুঁড়ার সাথে পরিমাণ মতো লাল চিনি বা আখের গুড় এবং বাকি সরিষার তেলটুকু ভালোভাবে মিশিয়ে পরিস্কার কাঁচের জারে সংরক্ষণ করতে হবে।
- উক্ত মিশ্রণটি কমপক্ষে ০৭ দিন জারে সংরক্ষণের পর তা ব্যবহার উপযোগী হবে।
সেবনবিধি:
- মিশ্রণটি ০৭ দিন সংরক্ষেণ রাখার পর প্রতিদিন সকালে গাভীকে ১০০ গ্রাম পরিমাণে খাওয়াতে হবে। এভাবে নিয়মিত খাওয়ালে গাভীর দুধ উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।
দুধ নষ্ট হওয়ার কারণ কি
দুগ্ধজাত খামারে দুধই হলো প্রধান পণ্য। তাই দুধ দোহন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। কিন্তু খামারের এই অত্যাবশ্যকীয় উপাদানটি বিভিন্ন কারণে দূষিত হতে পারে এবং খামারের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নিচে দুধ দূষিত হওয়ার বিভিন্ন কারণ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
- দুধ সাধারণত দোহন, ওজন নির্ণয়, পরিবহন এবং সংরক্ষণের সময় জীবাণু ও অন্যান্য পদার্থ দ্বারা দূষিত হতে পারে। জীবাণু গাভীর শরীর, দোহনকারী, বাতাস বা দুধের পাত্রসমূহ থেকেও সংক্রমিত হতে পারে।
- গাভীর শরীর বা ওলানের ময়লা দ্বারাও দুধে রোগ জীবাণু সংক্রমিত হয়ে দুধ দূষিত হতে পারে। তাই দুধ দোহনের পূর্বে গাভীর ওলান, পেটেল তলদেশ, বাঁট সর্বোপরি গাভীর পশ্চাৎদেশ কুসুম গরমপানি দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার করে নিতে হবে।
- দোহনকারীর হাত দ্বারাও দুধ দূষিত হতে পারে। তাই প্রতিবার দুধ দোহনের পূর্বে দোহনকারীর হাত জীবানুনাশক দিয়ে ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। দোহনকারীর হাতের নখ বড় রাখা যাবে না এবং হাতে বা শরীরের কোন স্থানে চর্মরোগ থাকলে দুধ দোহন করা যাবে না।
- বাতাসের মাধ্যমে দুধে ধুলা-বালি মিশে দুধ দূষিত হতে পারে। তাই, ঝড় বা বাতাস প্রবাহের সময় বা দুধ দোহনের স্থান ঝাড়ু দেওয়ার সময় দুধ দোহন করা যাবে না।
- দুধের পাত্র থেকেও দুধ দূষিত হতে পারে। তাই, দুধ দোহন, মাপা, পরিবহন এবং সংরক্ষণের জন্য যে সকল পাত্র বা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় তা অবশ্যই পরিস্কার ও জীবাণুমুক্ত হতে হবে।
- গাভীর ওলানের ভিতর কোন অসুখ থাকলে সেখান থেকেও দুধ দূষিত হতে পারে। তাই, ওলানের কোন অসুখ বা রোগ থাকলে তার চিকিৎসা করে নিতে হবে।
- বিভিন্ন পোকামাকড় যেমন- মশা, মাছি, তেলাপোকা, ইঁদুর ইত্যাদি দ্বারা দুধ দূষিত হতে পারে। তাই গোশালা, দুধ দোহনের জায়গা এবং দুধ সংরক্ষণের জায়গা সর্বদা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এসব স্থান পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখতে বায়োসিড-৩০, নেগুভন, আয়োসান, স্যাভলন, ডেটল প্রভৃতি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এসব পরিস্কারক যেন দুধে মিশে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- গাভী রক্ষণাবেক্ষণকারীর মাধ্যমেও দুধ দূষিত হতে পারে। তাই, গাভী রক্ষণাবেক্ষণকারী বা পরিচর্যাকারীকে অবশ্যই পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও রোগমুক্ত হতে হবে।
- দুধ একটু তাড়াতাড়ি দোহন করাই উত্তম। দোহনের পর পরই দুধকে ঠান্ডা স্থানে রাখতে হবে। হিমায়িত করার ব্যবস্থা থাকলে আরও ভালো। তবে দুধকে অধিক সময়ের জন্য সংরক্ষণ করতে হলে অবশ্যই পাস্তুরাইজেশন করতে হবে।
- রোগাক্রান্ত গাভীর মল, মূত্র বা অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ দ্বারা গাভীর ওলান ও পাশ্ববর্তী এলাকা সংক্রমিত হয়। তারপর সেখান থেকে রোগ জীবাণু দুধে প্রবেশ করে দুধ দূষিত হতে পারে।
লেখকের মন্তব্য
দুগ্ধজাত খামারে বিভিন্ন কারণে দুধ উৎপাদন কম বেশি হতে পারে যা উপরে আলোচিত হয়েছে। উপরোল্লিখিত গাভীর দুধ উৎপাদন কম বেশি হওয়ার কারণগুলো আমলে প্রাকৃতিক উপায়ে গাভীর দুধ বৃদ্ধির কৌশল অবলম্বন পূর্বক গাভী হতে আশানুরূপ দুধ উৎপাদন সম্ভব। এছাড়াও গাভীর দুধ বৃদ্ধির সুষম খাদ্য তালিকা এবং কিছু ঔষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে গাভীর দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়, যা ইতঃপূর্বে অন্য একটি আর্টিকেলে আলোচিত হয়েছে।
দুগ্ধজাত খামারীদের উদ্দেশ্যে রচিত এই আর্টিকেলে গাভীর দুধ উৎপাদন কম বেশি হওয়ার কারণ এবং প্রাকৃতিক উপায়ে দুধ বৃদ্ধির কৌশল সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আশাকরি আর্টিকেলটি পড়ে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারীরা উপকৃত হবেন। আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হলে আপনার পরিচিত খামারী কিংবা খামার স্থাপনে আগ্রহীদের সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইলো। এছাড়া আর্টিকেলটিতে কোন প্রকার ভুলত্রুটি পরিলক্ষিত হলে সংশোধনের নিমিত্তে কমেন্টবক্সে আপনার মতামত আশা করছি।
তথ্যসূত্র: উকিপিডিয়া, কৃষিজাগরণ, এগ্রোবাংলা, ড. মাহবুব মোস্তফা রচিত আধুনিক পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণ ও চিকিৎসা এবং দুগ্ধবতী গাভী পালন, ড. মো. জালাল উদ্দিন সরদার, অধ্যাপক, এনিমেল হাজবেন্ড্রী এণ্ড ভেটেরিনারি সায়েন্স বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী কর্তৃক রচিত এবং নূর পাবলিকেশন্স, বাংলাবাজার, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত “লাভজনক পশু পালন ও খামার ব্যবস্থাপনা” বই থেকে নেওয়া। খামার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান অর্জন করতে বই দুটি আপনার সংরক্ষণে রাখতে পারেন। |
আপনার সুচিন্তিত মতামত দিয়ে MrDorpon কে আরও সমৃদ্ধ করতে সহযোগিতা করুন। আপনার মতামতটি রিভিউর পর Published করা হবে।
comment url