দুধ উৎপাদনকারী গরুর জাত এবং দুগ্ধজাত গরু চেনার উপায়
দুধ উৎপাদনকারী গরুর জাত সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা ছাড়া শুধুমাত্র মনগড়া যেকোনা জাতের গাভী দিয়ে দুগ্ধজাত খামার স্থাপন করলে উক্ত খামারে সফলতা অর্জনের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তাই দুগ্ধজাত খামার প্রকল্প শুরু করার পূর্বে দুধ উৎপাদনকারী গরুর জাত চেনার উপায় সম্পর্কে কিছুটা পড়াশোনা এবং প্রতিষ্ঠিত ২-১টি দুগ্ধজাত খামার পরিদর্শন করা একান্ত জরুরী।
লাভজনক দুগ্ধজাত খামার ব্যবস্থাপনায় দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গরুর জাত একটি গরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই দুগ্ধজাত খামার ব্যবস্থাপনায় সফল হতে হলে একজন খামারীকে অবশ্যই দুধ উৎপাদনকারী গরুর জাত সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করা আবশ্যক।
ভূমিকা
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টির চাহিদা পূরণে ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে গরু পালন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত অধিক উৎপাদনশীল গরুর নিজস্ব কোন খাঁটি জাত নেই। কারণ আমাদের দেশের গরুর জেনেটিক্স পটেনশিয়ালিটি খুব কম হওয়ায় দুধ ও মাংস উৎপাদনের পরিমাণ তুলনামূলক অনেক কম। অপরিকল্পিত ও অবৈজ্ঞানিক উপায়ে গরু পালনের কারণে গরুর উৎপাদন যেমন কম তেমনি গরুর মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের দামও আকাশচুম্বী।
আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে বাংলাদেশে এখনও প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত দেশীয় পদ্ধতিতে খামার ব্যবস্থাপনা পরিচালানা করছে। যারা করছে তাদের বেশিরভাগই অশিক্ষিত কিংবা স্বল্পশিক্ষিত। অথচ সম্ভাবাময় এই ক্ষেত্রটিতে শিক্ষিতরা যদি এগিয়ে আসে তাহলে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি দেশ ও জাতির জন্যও মঙ্গলজনক হবে। তাই স্বল্প দামে প্রোটিনের মূল উৎস দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে দুগ্ধজাত খামার স্থাপনে শিক্ষিত, তরুণ ও মেধাবী উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আস উচিত।
দুধ উৎপাদনকারী গরুর জাত
অধিক পরিমাণে দুধ উৎপাদনকারী বিভিন্ন জাতের গরুর কিছু সতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর মধ্যে কিছু কমন বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলো সাধারণত দুগ্ধজাত সকল গরুর মধ্যে বিদ্যমান। দুধ উৎপাদনকারী গরুর কমন বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:
- এদের দেহ গোঁজ আকৃতির হয়।
- পেট বৃহৎ এবং প্রশস্ত হয়।
- এদের চামড়া হবে কোমল এবং বেশ ঢিলেঢালা।
- ওলান সামনের দিকে বিস্তৃত থাকবে, ওলানের সামনের অংশ পেটের কাছে গিয়ে শেষ হবে এবং পেছনের অংশ দুই উরুর মাঝে গিয়ে শেষ হবে।
নিচে দুধ উৎপাদনকারী গরুর জাত এবং তাদের উৎপত্তি ও বিস্তৃতি সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
- আয়ারসায়ার (Ayrshire): দুই থেকে তিন শতাব্দী পূর্বে উত্তর-পশ্চিম স্কটল্যান্ডের আয়ারসায়ার নামকে দেশে এটি দেশী জাতের গরু হিসেবে লালন-পালন করা হতো। সেজন্য তার উৎপত্তিস্থলের নামানুসারে গরুটি নামকরণ করা হয় আয়ারসায়ার।১৮২২ সালে আমেরিকা এই জাতের গরু প্রথমে নিয়ে আসে এবং ১৮৫৯ সালে ‘আয়ার পশুপালন বই’ নামে একটি বই প্রকাশ করে।
- ব্রাউন সুইস (Brown Swiss): ব্রাউন সুইস এর উৎপত্তি সুইজারল্যান্ডে। সুইজারল্যান্ডের সুইস আলপস নামক পর্বতময় জায়গায় এদের লালন পালন করা হয়। ব্রাউন সুইস এখন ইটালি, আমেরিকা, মেক্সিকো এবং সাউথ আমেরিকাসহ অনেক দেশে পাওয়া যায়।
- গার্নসি (Guernsey): গার্নসি জাতের এই দুধ উৎপাদনকারী গরুটির উৎপত্তিস্থর ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত চ্যানেল দ্বীপপুঞ্জের আইল অব গার্নসিতে। তাই এর উৎপত্তি স্থানের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় গার্নসি।
- হলস্টিয়ান ফ্রিজিয়ান (Holstein-Friesian): হলিস্টিয়ান ফ্রিজিয়ান জাতের গরুর উৎপত্তি হল্যান্ডের ফিজল্যান্ড প্রদেশে। ১৯৭৫ সালে এদের আমেরিকায় নিয়ে আসা হয়। ‘হলস্টিয়ান প্রজননকারী সংস্থা’ এবং ‘ডাচ ফ্রিজিয়ান সংস্থা’র যৌথ উদ্যোগে এর নামকরণ করা হয় ‘হলস্টিয়ান ফ্রিজিয়ান’। হলস্টিয়ান ফ্রিজিয়ান আমেরিকায় শুধুমাত্র ‘ফ্রিজিয়ান’ নামে পরিচিত। বর্তমানে আমেরিকায় দুগ্ধবতী গরুর সংখ্যার ৯০ শতাংশই এই হলস্টিয়ান ফ্রিজিয়ান জাতের গরু।
- জার্সি (Jersey): জার্সি জাতের এই দুধ উৎপাদনকারী গরুটির উৎপত্তি ব্রিটিশ চ্যানেল দ্বীপপুঞ্জের জার্সি দ্বীপে। এই জাতের গরু ১৭৪০ সালের দিকে ইংল্যান্ডে এবং ১৮৫০ সালের দিকে আমেরিকায় নিয়ে আসা হয়।
- শাহিওয়াল (Shahiwal): শাহিওয়াল জাতের গরুকে অনেকে মোন্তগোমারী নামেও চিনে। পাকিস্তানের পশ্চিম পাঞ্জাবের মোন্তগোমারী নামক জেলায় এর উৎপত্তি। উৎপত্তিস্থানের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় মোন্তগোমারী। যদি বর্তমানে আমাদের দেশে মোন্তগোমারীর চেয়ে শাহিওয়াল নামটিই বেশ পরিচিত। এছাড়াও একে অনেকে লোলা, লাম্বি বার, মুলতানী, টেলি নামে চেনে। এটি একটি অধিক দুধ উৎপাদনকারী উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জাত। গরম আবহাওয়ায় একে পালন করা যায় বিধায় বাংলাদেশ ও ভারতে এর চাহিদা ব্যাপক।
- সিন্ধি (Sindhi): প্রকৃত সিন্ধি জাতের গরু পাওয়া গিয়েছিল পাকিস্তানের করাচির বাইরে মালির নামক স্থানে। এই সিন্ধি গরু পৃথিবীর গ্রীষ্মমন্ডলীয় সকল অঞ্চলে রপ্তানি করা হয়। আমাদের দেশে দুগ্ধজাত গাভী হিসেবে সিন্ধি গরুর চাহিদা ব্যাপক।
- ডাচ বেল্টেড (Dutch Belted): এ জাতের গরুর প্রথম দেখা মেলে ১৭৫০ সালের দক্ষিণ পূর্ব সুইজারল্যান্ডে এবং অস্ট্রেলিয়াতে। কিন্তু তথ্য অনুসারে দেখা যায় এদের উন্নয়নকরণ করা হয় হল্যান্ডে। এদের আমেরিকায় প্রথম নিয়ে আসা হয় ১৮৩৮ সালে। ১৭৮৬ সালে আমেরিকায় এদের জন্য “Dutch Belted Cattle Association” নামক সংস্থা খোলা হয়।
- গির (Gir): গির মূলত দ্বৈত উদ্দেশ্যের গরুর একটি জাত। এর উৎপত্তি গির নামক পাহাড়ে এবং ভারতের পশ্চিম উপকূলের দক্ষিণ কাথিয়াওয়ার ও জুনাগাধ নামক জঙ্গলে। ধারণা করা হয় গির এর রক্ত মেওয়াটি, ডিকানি, কৃশনা ভ্যালি এবং নিমারি জাতের গরুতে আছে। গির রক্তের গ্রুপ থেকে জানা যায় এদের বাছাই করা হয়েছিল রেড সিন্ধি, শাহিওয়াল, আফগান জাতের গরু থেকে।
- হারিয়ানা (Hariana): হারিয়ানা জাতের গরুও দ্বৈত উদ্দেশ্যের গরুর একটি জাত। এদের উৎপত্তি পূর্ব পাঞ্জাব, ভারত এবং উত্তর গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশে। হরিয়ানা জাতের গরু এখন অনেক দেশে বিস্তৃত। এদেরকে দুধ উৎপাদনের পাশাপাশি কৃষিকাজের জন্যও ব্যবহার করা হয়।
দুধ উৎপাদনকারী গরুর জাত চেনার উপায়
সাধারণত শারীরিক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমেই গরুর জাত চেনা যায়। তাই দুধ উৎপাদনকারী গরুর জাত চেনার জন্য উপরোল্লিখিত প্রতিটি গরুর শারীরিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান থাকা আবশ্যক। নিচে দুগ্ধজাত গরু চেনার উপায় সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
আয়ারসায়ার জাতের গরু চেনার উপায়
- আয়ারসায়ার এর গায়ের বর্ণ লালচে তামাটে এবং সাদা অথবা মেহগোনি এবং সাদা রংয়ের মিশ্রণের যেকোন একটি হতে পারে।
- এ জাতের অনেক ষাঁড়ের ক্ষেত্রে মেহগোনি রঙটা দেখতে কিছু কিছু সময় কালোর কাছাকাছি মনে হয়।
- এদের শিং বাইরের দিকে উপরে কিছুটা উঠে পেছনের দিকে বেঁকে গেছে।
- একটি পর্ণবয়স্ক আয়ারসায়ার এর পায়ের পাতা থেকে কাঁধ পর্যন্ত ৫৪ ইঞ্চি।
- এরা চমৎকার চরতে পারে এবং খুব সুন্দর কৌশলে তৃপ্তিসহকারে ঘাস ও কোমল গাছপালা খায়।
- তাদের ওলান সুগঠিত এবং প্রতিসম, যা খুব ভালোভাবেই শরীরের সাথে যুক্ত।
- সুগঠিত দেহের জন্য তারা আজপর্যন্ত বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত।
ব্রাউন সুইস জাতের গরুর বৈশিষ্ট্য
- ব্রাউন সুইস দেখতে গাড় তামাটে অথবা ধূসর বর্ণের এবং ঘন রঙের হয়।
- তারা ফ্রিজিয়ান গরু থেকে সামান্য ছোট এবং ওজনেও সামান্য কম হয়।
- এদের শারীরিক কাঠামো বেশ বলিষ্ঠ এবং শরীরের হাঁড়গুলো অনেক বড়।
- এদের নাক এবং জিহ্বা কালো।
- ব্রাউন সুইস জাতের গরুর নাক এবং মুখের চারপাশে উজ্জ্বল রঙের রেখা আছে।
- এ জাতের গরু বেশ শান্ত যার জন্য এদের অতি সহজেই লালন পালন করা যায়।
গার্নসি জাতের গরু চেনার উপায়
- গার্নসি গরুর গায়ের বর্ণ কিছুটা মৃগশিশুর ন্যায় যার মধ্যে সাদা দাগ আছে। এই বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে এদের সহজেই চেনা যায়।
- এদের মাথার দৈর্ঘ্য বেশ বড়, শিং সামনের দিকে নত এবং শিং এর শেষ প্রান্ত ক্রমশ: সরু হয়ে গেছে।
- এদের দুধে অধিক পরিমাণে চর্বি এবং বিটা ক্যারোটিন আছে যার কারণে এদের দুধের বর্ণ গাঢ় হলুদ।
হলেষ্টিয়ান ফ্রিজিয়ান গাভী চেনার উপায়
- হলস্টিয়ান গরুর গায়ের বর্ণ কালো ও সাদা অথবা লাল ও সাদা কিংবা শুধু কালো বর্ণেরও হয়ে থাকে।
- এদের কুঁজ থাকে না।
- এরা খুব শক্তিশালী এবং স্বাস্থ্যবান গরু।
- এদের নাক এবং মুখ চওড়া, নাসারন্ধ্র খোলা, মজবুত চোয়াল এবং লেজের নিচের অংশ অথবা ওলানের পার্শ্বে সাদা থাকে।
- এ জাতের গাভীগুলো খুবই শান্ত কিন্তু বলদ এবং ষাঁড়গুলোকে আয়ত্ত্বে নিয়ে আসা খুবই কঠিন।
জার্সি গাভীর বৈশিষ্ট্য / জার্সি গরু চেনার উপায়
- এদের গায়ের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বর্ণ হচ্ছে আংশিক মৃগশিশুর বর্ণ, যার মধ্যে সাদা দাগ থাকতেও পারে এবং চোখের চারপাশে কাল বৃত্ত আছে।
- এদের পিঠ হয় সোজা এবং মেরুদন্ডের প্রান্তভাগ হয় সমতল।
- কপাল বেশ চওড়া এবং চোখগুলোও বেশ উজ্জ্বল।
- এদের মাথা হয় সুগঠিত যা শরীরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
- জার্সি গরুর ওলান বেশ দৃঢ় ও সুগঠিত যা শরীরের সাথে সুন্দরভাবে যুক্ত এবং তাদের বাচ্চা প্রসবে কোন জটিলতা নেই।
- এদের শরীরের কাঠামো বেশ শক্ত যার কারণে তারা যেকোন পরিবেশে বিশেষ করে খুব গরমেও নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
- এদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য খুব কম খরচ হয় কারণ তাদের দেহটা খুব ছোট-খাটো।
- প্রজননের সময় জার্সি ষাঁড় ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশ সতর্ক থাকতে হয় কারণ এদের ব্যবহার খুবই রুক্ষ্ম।
শাহিওয়াল বাছুর চেনার উপায় / শাহিওয়াল গরু চেনার উপায়
- এদের গায়ের রং লালচে পিঙ্গল বর্ণের। আবার কিছুটা ফ্যাকাশে লাল বর্ণের, গাঢ় তামাটে যার মধ্যে কালো বর্ণের ডোরা কাটা দাগ থাকে। কখনও কখনও সাদা ও কালো বর্ণের শাহিওয়াল গরুও দেখা যায়।
- একটি পূর্ণবয়স্ক শাহিওয়াল গরু দীর্ঘ শরীরের অধিকারী ও খুবই স্বাস্থ্যবান।
- এদের পাগুলো ছোট ছোট, শরীরটা গভীর এবং অধিক মাংসযুক্ত। এদের দেখতে কিছুটা অলস মনে হয়।
- শাহিওয়াল গরুর চামড়াগুলো বেশ ঝোলা এবং নমনীয়।
- এদের গায়ের লোমগুলো অতি সূক্ষ্ম এবং চকচকে।
- শাহিওয়াল গরুর মাথা বেশ চওড়া। বিশেষ করে পুরুষ গরুর মাথা বৃহদায়তন, তাদের কান মধ্যম আকৃতির যার কিনারাগুলোতে কালো বর্ণের ঝালোর আছে।
- এদের শিং খুবই ছোট এবং মোটা।
- পুরুষ শাহিওয়ালের কুঁজটা বৃহদায়তন যা একদিকে বেঁকে ঝুলে থাকে।
- তাদের গলকম্বল খুব বড় এবং ভারী।
- এদের নাভী এবং নাভীর আবরণ বেশ ঢিলেঢালা এবং ঝুলন্ত।
- শাহিওয়ালের ওলান বেশ বড় এবং বাঁটের আকার খুবই সুন্দর।
- এদের দুগ্ধদান সময় বাড়ার সাথে সাথে ওলান দোদুল্যমান হতে থাকে।
সিন্ধি জাতের গরু চেনার উপায়
- সিন্ধি জাতের গরুর প্রকৃত বর্ণ লাল। তবে এরা কালো ও পিঙ্গল হলুদ বর্ণেরও হতে পারে।
- লাল সিন্ধি মধ্যম থেকে ছোট আকারের হয় যার রয়েছে গভীর, ঘন, গোলাকার শারীরিক গঠন।
- গলকম্বলে এবং কপালে সাদা বর্ণের দাগ থাকে।
- কাঁধের এবং উরুর দিকের অংশের বর্ণ আরও গাঢ়।
- লোম ছোট এবং কোমল, গায়ের চামড়া ঢিলেঢালা, যা মধ্যম পুরুত্বের এবং চামড়া বিভিন্ন বর্ণে রঞ্জিত।
- কান মাঝারি অথবা বড় ধরনের হতে পারে যা ঝুলে থাকে।
- শিংগুলোর গোড়া মোটা, যা উপরের দিকে একটু বেঁকে গেছে এবং এই শিং এর আগা ভোঁতা।
- তাদের গলকম্বল এবং তলপেটের আবরণ দোদুল্যমান।
- পাগুলো ছোট কিন্তু লেজ বড়।
- সুগঠিত ওলান আছে যার বোঁটাগুলো মধ্যম আকৃতির।
- বয়স বাড়ার সাথে সাথে এদের ওলান দোদুল্যমান হয়ে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে এদের ওলান অযথা বড় হয়ে যায়।
গির জাতের গরুর বৈশিষ্ট্য
- এদের দেহ বেশ বড়, দৃঢ় কাঠামো এবং সুস্পষ্ট ও প্রশস্ত কপাল।
- এদের কানগুলো লম্বা এবং দোদুল্যমান।
- গির এর চামড়ার বর্ণ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। যেমন- হলদে, লঅল, কালো, সাদার সাথে মিশ্রিত গাঢ় লাল অথবা তামাটে বর্ণের দাগ থাকে।
- এদের গায়ের চামড়া ঢিলেঢালা, গলকম্বল মধ্যম গঠনের।
- গির জাতের ষাঁড়ের তলপেটের চামড়া দোদুল্যমান।
- শিং মাঝারি আকৃতির, যা মাথার পেছনে কিছুটা নিম্নগামী এবং তারপর শিংটি সামনের দিকে হেলে বেঁকে গেছে এবং শিং এর শেষ প্রান্ত ক্রমশঃ সরু হয়ে গেছে। এক কথায়, গির গরুর শিং কিছুটা প্যাঁচানো আকৃতির।
- বুকের শেষ হাড়ের জায়গাটি বড়, গভীর এবং সুন্দর গোলাকার।
- পাগুলো শরীরের সাথে সমকোণে অবস্থিত।
- এদের ওলান ও বাঁট সুগঠিত।
হরিয়ানা জাতের গরু চেনার উপায়
- দেহের বর্ণ সাদা থেকে ধূসর বর্ণের এবং ষাঁড়ের ক্ষেত্রে পেছনের অংশ গভীর কালো।
- এদের দেহ আঁটসাঁট প্রকৃতির এবং দেখতে বেশ সুন্দর।
- এদের মুখমন্ডল লম্বা এবং অপ্রশস্ত।
- এদের মাথার উপরিভাগের মাঝখানে সমুন্নত অস্থিসন্ধি আছে।
- এদের কানগুলো ছোট কিন্তু ছোট হলেও অনেক ক্ষেত্রে কানগুলো দোদুল্যমান থাকে।
- এদের শিংগুলো ছোট কিন্তু দেখতে সুন্দর। গাভীর শিং ষাঁড়ের শিং থেকে ছোট এবং পাতলা।
- ষাঁড়ের ক্ষেত্রে কুঁজ বড় এবং সুগঠিত কিন্তু গাভীর ক্ষেত্রে মধ্যম আকৃতির।
- এদের গলকম্বল মাঝারি ধরনের কিন্তু সুগঠিত এবং ষাঁড়ের ক্ষেত্রে গলকম্বল হালকা গড়নের।
- তলপেটের চামড়া ছোট এবং শরীরের সাথে আটসাঁট থাকে।
- নাভির চামড়া দোদুল্যমান নয়, লেজ চিকন এবং ছোট।
- হারিয়ানা গাভীর ওলান তুলনামূলকভাবে বড় এবং সামনের দিকে বিস্তৃত।
কোন জাতের গরু কত লিটার দুধ দেয়
দুধ উৎপাদনের পরিমাণ নির্ভর করে গরুর জাতের উপর। বিভিন্ন জাতের গরুর দুধ উৎপাদনের হার ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, দুধের সাধ ও পুষ্টিগুণের মধ্যেও গরুর জাতের উপর নির্ভর করে তারতম্য ঘটে। তাই দুগ্ধজাত খামার স্থাপনের পূর্বে একজন খামারীর উচিত কোন জাতের গরু কত লিটার দুধ দেয় তা জেনে নেওয়া। নিচে কোন জাতের গরু কত লিটার দুধ দেয় সে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
আয়ারসায়ার জাতের গরু কত লিটার দুধ দেয়
- আয়ারসায়ার গরু প্রচুর পরিমাণে দুধ দেয়। এ জাতের গরুর দুধে সামান্য পরিমাণ চর্বি এবং প্রোটিন আছে। এর চর্বির পরিমাণ ৪%।
- আয়ারসায়ার গাভী তার ৩০৫ দিন দুগ্ধদানকালে সর্বমোট দুধ দেয় প্রায় ১২,১৫৫ লিটার।
- একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ আয়ারসায়ারের ওজন ৭০০ থেকে ৮০০ কেজি এবং আয়ারসায়ার গাভীর ওজন ৫০০ থেকে ৬০০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
- যেকোন পরিবেশে এর সহ্য ক্ষমতা কম হওয়ার কারণে বাংলাদেশে এর লালন-পালন খুব একটা দেখা যায় না।
ব্রাউন সুইস গরু কত লিটার দুধ দেয়
- ব্রাউন সুইস দুগ্ধদানকালে সর্বমোট দুধ দেয় ৫,০০০ লিটার।
- পূর্ণবয়স্ক একটি পুরুষ ব্রাউন সুইস গরুর ওজন ৭০০ থেকে ৮০০ কেজি এবং গাভীর ওজন ৫০০ থেকে ৬০০ কেজি।
- ব্রাউন সুইসকে তাদের মাতৃভূমিতে দুধ উৎপাদন, মাংস উৎপাদন এবং কৃষিকাজে ব্যবহার করে থাকে।
- এ জাতের গরুও সকল আবহাওয়ায় নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পারায় বাংলাদেশে এ জাতের গরু খুব একটা দেখা যায় না।
গার্নসি গরু কত লিটার দুধ দেয়
- গার্নসি গরু তার দুগ্ধদানকালে সর্বমোট ৮,০০০ লিটার দুধ দেয়। অনেক খামারে দেখা গেছে এরা ১৩,৪৮৪ লিটার পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে। এদের দুধে চর্বির পরিমাণ ৫%।
- পূর্ণবয়স্ক একটি পুরুষ গার্নসি গরুর ওজন ৬০০ থেকে ৮০০ কেজি এবং গাভীর ওজন ৪০০ থেকে ৫০০ কেজি।
হলস্টিয়ান ফ্রিজিয়ান গরু কত লিটার দুধ দেয়
- এরা অল্প সময়ে প্রচুর পরিমাণ দুধ এবং উচ্চমানের মাংস উৎপাদন করে।
- এই জাতের গরুগুলো বেশ বড়, পুরুষ গরুগুলোর ওজন ৮০০ থেকে ৯০০ কেজি এববং গাভীর ওজন ৫০০ থেকে ৬০০ কেজি।
- সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং পরিমিত পরিমাণে সুষম খাদ্য নিশ্চিত করতে পারলে এরা প্রতি দুগ্ধদানকালে ৬০০০ থেকে ৭০০০ লিটার পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে।
- এ জাতের গাভীর সর্বোচ্চ ১৯,০০০ লিটার পর্যন্ত দুধ দেওয়ার রেকর্ড আছে।
- এ জাতের বকনাগুলো সাধারণত প্রথম বাচ্চা দেয় ২৮ থেকে ৩২ মাস বয়সে। তারপর থেকে এরা প্রতি ১২ থেকে ১৩ মাস অন্তর অন্তর বাচ্চা দিয়ে থাকে।
জার্সি গরু কত লিটার দুধ দেয়
- জার্সি গরুর পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। কারণ এই গরু যেকোন পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
- এ জাতের গরুর দুধে চর্বির পরিমাণ ৫% এবং মাখনের পরিমাণ অত্যন্ত বেশি।
- এ জাতের বকন প্রথম বাচ্চা দেয় ২৫ থেকে ৩০ মাস বয়সে। এরপর থেকে একটি সুস্থ জার্সি গাভী প্রতি ১২ থেকে ১৩ মাস অন্তর অন্তর বাচ্চা দিতে থাকে।
- পরিপূর্ণ যত্ন পেলে এরা তাদের দুগ্ধদানকালে প্রায় ৪,৫০০ লিটার পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে।
- পূর্ণবয়স্ক একটি পুরুষ জার্সি গরুর ওজন ৬০০ থেকে ৭০০ কেজি এবং গাভীর ওজন ৫০০ থেকে ৬০০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
শাহিওয়াল গরু কত লিটার দুধ দেয়
- শাহিওয়াল একটি দুগ্ধজাত গরু হলেও এরা মাংস উৎপাদনের জন্যও বেশ পরিচিত। এছাড়া এদেরকে ভারবাহী কাজেও ব্যবহার করা হয়।
- একটি শাহিওয়াল গরু গ্রাম্য ব্যবস্থাপনায় তার প্রতি দুগ্ধদানকালে দুধ দেয় ২১৫০ লিটার। কিন্তু একই গরু খামার ব্যবস্থাপনায় দুধ দেয় ৪-৫ হাজার লিটার।
- একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ শাহিওয়াল গরুর ওজন ৪৫৫ থেকে ৫৯০ কেজি এবং গাভীর ওজন ২৭২ থেকে ৪০৯ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
সিন্ধি গরু কত লিটার দুধ দেয়
- লাল সিন্ধিকে ভারতীয় উপমহাদেশে ভাল দুধ উৎপাদনকারী জাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
- এদেরকে হালকা কাজের জন্যও ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
- একটি সিন্ধি গরু প্রতি দুগ্ধদানকালে প্রায় ১,১০০ লিটার থেকে ৫৪৪৩ লিটার পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে।
- পূর্ণবয়স্ক একটি পুরুষ সিন্ধি গরুর ওজন ৪৫০ থেকে ৫০০ কেজি এবং গাভীর ওজন ৩০০ থেকে ৩৫০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
গির গরু কত লিটার দুধ দেয়
- গির জাতের গরুর দুধ উৎপাদন ক্ষমতা মোটামুটি সন্তোষজনক। এদের কৃষিকাজের জন্যও ব্যবহার করা যায়।
- ভারতের বাহিরে এদের মাংস উৎপাদনকারী হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি আছে।
- গির জাতের গরু প্রতি দুগ্ধদানকালে ১২২৫ লিটার থেকে ২২৬৮ লিটার পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে। এ জাতের গরুর সর্বোচ্চ ৩১৭৫ লিটার পর্যন্ত দুধ দেওয়ার রেকর্ড আছে।
- পূর্ণবয়স্ক একটি পুরুষ গির গরুর ওজন সর্বোচ্চ ৫৩৩ কেজি এবং গাভীর ওজন সর্বোচ্চ ৩৮৬ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
হারিয়ানা গরু কত লিটার দুধ দেয়
- হারিয়ানা জাতের বলদগুলো খুবই শক্তিশালী যার জন্য এরা মালামাল বহন এবং কৃষিকাজের জন্যও ব্যবহার করা হয়।
- এ জাতের গরু প্রতি দুগ্ধদানকালে ৪৫৩৬ লিটার পর্যন্ত দুধ দেওয়ার রেকর্ড আছে।
- পূর্ণবয়স্ক একটি পুরুষ হারিয়ানা গরুর ওজন পায় ৪৫০ কেজি এবং গাভীর ওজন প্রায় ৩৫০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
লেখকের মন্তব্য
দুগ্ধজাত খামারের প্রধান হাতিয়ারই হলো গাভী। তাই দুগ্ধজাত খামারে লাভবান হতে হলে সুনির্দিষ্ট দুধ উৎপাদনকারী গরুর জাত নির্বাচন করে খামার স্থাপন করা একান্ত জরুরী। দুগ্ধজাত খামার স্থাপন প্রত্যাশী খামারীদের জন্য দুধ উৎপাদনকারী গরুর জাত এবং দুগ্ধজাত গরু চেনার উপায় সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার ক্ষুদ্র প্রয়াস থেকেই রচিত এই আর্টিকেলটি। আশাকরি আর্টিকেলটি নতুন এবং পুরাতন উভয় খামারীদের জন্যই মঙ্গলজনক হবে।
আর্টিকেলে রচিত সমুদয় তথ্য নির্ভরযোগ্য উৎস হতে সংগ্রহ ও সংকলন শেষে আপনাদের প্রিয় MrDorpon প্লাটফর্মে উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে কোনো প্রকার ভুলত্রুটি পরিলক্ষিত হলে কিংবা কোনো তথ্য সংযোজন, বিয়োজন বা পরিমার্জনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলে কমেন্ট বক্সে আপনার সুচিন্তিত মতামত পেশ করুন। আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হলে আপনার পরিচিত খামার স্থাপনে আগ্রহীদের সাথে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।
তথ্যসূত্র: উকিপিডিয়া, এগ্রোবাংলা, ড. মাহবুব মোস্তফা রচিত আধুনিক পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণ ও চিকিৎসা এবং দুগ্ধবতী গাভী পালন, ড. মো. জালাল উদ্দিন সরদার, অধ্যাপক, এনিমেল হাজবেন্ড্রী এণ্ড ভেটেরিনারি সায়েন্স বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী কর্তৃক রচিত এবং নূর পাবলিকেশন্স, বাংলাবাজার, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত “লাভজনক পশু পালন ও খামার ব্যবস্থাপনা” বই থেকে নেওয়া। খামার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান অর্জন করতে বই দুটি আপনার সংরক্ষণে রাখতে পারেন। |
আপনার সুচিন্তিত মতামত দিয়ে MrDorpon কে আরও সমৃদ্ধ করতে সহযোগিতা করুন। আপনার মতামতটি রিভিউর পর Published করা হবে।
comment url