গরুর গলাফুলা রোগের লক্ষণ, চিকিৎসা এবং এর টিকা দেওয়ার নিয়ম
গরুর গলাফুলা রোগের লক্ষণ বা উপসর্গ দেখার সাথে সাথে প্রতিকারমূলক প্রয়োজনীয় চিকিৎসার মাধ্যমে কখনও কখনও এই রোগ থেকে পশুকে বাঁচানো যায়। তবে গরুর গলাফুলা রোগের চিকিৎসার চেয়ে আক্রান্ত হওয়ার পূর্বে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর পশুর জন্য গলাফুলা রোগের টিকাই উত্তম ও কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের আশীর্বাদস্বরূপ গবাদিপশুর বিভিন্ন সংক্রামক রোগের টিকা আবিস্কারের ফলে বর্তমানে পশু মৃত্যুর হার অতীতের তুলনায় অনেকাংশেই কমে গেছে। তবে এখনও প্রান্তিক পর্যায়ের কিছু পারিবারিক খামারে কৃষকের অজ্ঞতার কারণে পশুকে শতভাগ ভ্যাকসিনের আওতায় আনা সম্ভব হয়ে উঠেনি।
ভূমিকা
খামার ব্যবস্থাপনায় সফল হতে এবং পশু সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে উন্নত চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি পশুকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর টিকা দেওয়া খুবই জরুরী। টিকা আবিস্কার কিংবা এর সহজল্যভতার পূর্বে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক পশু মারা যাওয়ার তথ্য আছে। সম্প্রতি টিকার সহজলভ্যতার ফলে এসব সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে পশুমৃত্যের হার অনেকাংশেই কমে গেছে। তাই টিকার অভাবে যেন কোনো পশুর মৃত্যু না হয় সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রত্যেক খামারীর উচিত।
অন্যথায় একটি পশুও যদি এই রোগে আক্রান্ত হয় তাহলে তা মহামারি আকার ধারণ করতে খুব বেশি সময় লাগবে না। কোনো খামারে পশু এ রোগে আক্রান্ত হলে একদিকে যেমন খামারীদের ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় তেমনি পশুর আকস্মিক মৃত্যুতে জাতীয় অর্থনীতিতেও ব্যাপক ক্ষতি সাধণ হয়ে থাকে যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই প্রত্যেক খামারীর উচিত পশু সুস্থ থাকায় অবস্থায় পশুকে নির্দিষ্ট ভ্যাকসিনের আওতায় আনা।
গলাফুলা রোগের কারণ
গরুর গলাফুলা রোগ একটি ব্যাকটেরিয়াল রোগ যা এক প্রকার জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গবাদিপশু যেমন- গরু, মহিষ, ঘোড়া, ছাগল ও ভেড়ার মধ্যে এ রোগে আক্রান্ত হতে দেখা গেলেও বাংলাদেশে গরু ও মহিষের মধ্যেই এর প্রাদুর্ভাব বেশি পরিলক্ষিত হয়। পশু সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জরিপ অনুযায়ী গত কয়েক বছরে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে অসংখ্য মহিষ মারা যাওয়ার তথ্য আছে। উক্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী যেকোনো বয়সের পশু এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
সাধারণত বর্ষার পর পর স্যাঁতস্যাঁতে জমিতে পশুকে চরালে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এছাড়াও যেহেতু রোগটি সংক্রামক রোগ এবং ছোঁয়াচে তাই অসুস্থ প্রাণির সংস্পর্শে, লাল, মলমূত্র, দুষিত খাদ্য ও পানি দ্বারাও এ রোগ ছড়াতে পারে। পাসচুরেলা মাটোসিডা (Pasteurella mutocida) এবং পাসচুরেলা হেমোলাইটিকা (Pasteurella haemolytica) নামক ব্যাকটেরিয়া এ রোগের বাহক। তাই গলাফুলা রোগের কারণ হিসেবে এরাই দায়ী।
গরুর গলাফুলা রোগের লক্ষণ
প্রাথমিক অবস্থায় গরুর গলাফুলা রোগের লক্ষণ হিসেবে কোনো প্রকার উপসর্গ দেখা যায় না বিধায় এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর পশুকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য খুব বেশি সময় পাওয়া যায় না। গরুর তড়কা রোগের ন্যায় গলাফুলা রোগের ক্ষেত্রেও অতিতীব্র ও তীব্র এই দুই প্রকৃতির হয়ে থাকে। নিচে গরুর গলাফুলা রোগের লক্ষণসমূহ উপস্থাপন করা হলো:
গরুর গলাফুলা রোগের অতিতীব্র লক্ষণসমূহ:
- আক্রান্ত পশুর মধ্যে এ রোগ অতিতীব্র আকার ধারণ করলে পশুর জ্বর আসে এবং জ্বরের তীব্রতা ১০৫ ডিগ্রী থেকে শুরু করে ১০৭ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে থাকে।
- পশুর মধ্যে ব্যাপক হারে ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়।
- নাক ও মুখ দিয়ে লালা ঝরে এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পশু মারা যায়।
গরুর গলাফুলা রোগের তীব্র লক্ষণসমূহ:
- প্রথমে গলার নিচে, পরে চোয়াল, বুক, পেট ও কানের অংশ ফুলে যায়।
- আক্রান্ত পশুর শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ফলে গলা বাড়িয়ে মুখ দিয়ে শ্বাস নেয়।
- শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় ঘড়-ঘড় শব্দ হয়।
- গরুর গলা ফুলার সাথে সাথে মাথাও ফুলে যায়।
- মাথা, গলা বা গলকম্বল ফুলে গেলে অনেকটা ইডিমা রোগের মত দেখায়।
- আক্রান্ত পশু খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়।
- আক্রান্ত পশু ডায়রিয়াও দেখা দিতে পারে।
- তীব্র প্রকৃতির গলাফুলা রোগে আক্রান্ত পশু ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়।
গরুর গলাফুলা রোগের চিকিৎসা
হঠাৎ আবহাওয়ার পরিবর্তন ও বর্ষা ঋতুতে একটানা পরিশ্রম করা পশুর ক্ষেত্রে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাসের উপর নির্ভর করে এবং কিছু বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপসর্গ দেখে এ রোগ র্নির্ণয় করতঃ পশু চিকিৎসকগন নিম্নোক্ত চিকিৎসাপত্র প্রদান করে থাকেন:
Rx(১) |
|
প্রয়োগবিধি: উপরের যে কোন একটি ইনজেকশন ১০০-১৫০ কেজি ওজনের পশুর জন্য প্রথম দিন ৪০-৫০ মি.লি. এবং দ্বিতীয় দিন থেকে পর পর ৪/৫ দিন ৩০ মি.লি. করে আক্রান্ত পশুর শিরা বা মাংসপেশীতে দিতে হবে। | |
অথবা, |
|
প্রয়োগবিধি: উপরের যে কোন একটি ইনজেকশন ১০০-১৫০ কেজি ওজনের পশুর জন্য প্রত্যহ ১০-১৫ মি.লি. করে পর পর ৩-৪ দিন আক্রান্ত পশুর মাংসপেশীতে দিতে হবে। | |
অথবা, |
|
প্রয়োগবিধি: উপরের যে কোন একটি ইনজেকশন ১০০-১৫০ কেজি ওজনের পশুর জন্য প্রত্যহ ১০-১৫ মি.লি. করে পর পর ৩-৪ দিন আক্রান্ত পশুর মাংসপেশীতে দিতে হবে। | |
(২) |
|
প্রয়োগবিধি: উপরের যে কোন একটি ইনজেকশন মাঝারি/বড় সাইজের পশুর জন্য প্রত্যহ ৫-১০ মি.লি. করে পর পর ৫-৭ দিন আক্রান্ত পশুর মাংসপেশীতে দিতে হবে। | |
(৩) |
|
প্রয়োগবিধি: উপরের ইনজেকশনগুলো মূলত ব্যাথানাশক। ব্যথা সাপেক্ষে উপরের যে কোন একটি ইনজেকশন প্রতি ১০০ কেজি দৈহিক ওজনের পশুর জন্য প্রত্যহ ২-৩ মি.লি. করে পর পর ২-৩ দিন আক্রান্ত পশুর চামড়ার নিচে দিতে হবে। | |
(৪) | Boric Powder / Magnesium sulphate / খাবার লবন |
প্রয়োগবিধি: উপরোক্ত যেকোন একটি উপকরণ ২০০ গ্রাম পরিমাণে নিয়ে কুসুম গরম পানির সাথে মিশিয়ে আক্রান্ত পশুর ফোলা স্থানে দিনে ৪-৬ বার শেক দিতে হবে। |
গলাফুলা রোগের টিকা দেওয়ার নিয়ম
গরুর গলাফুলা রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর আক্রান্ত পশুকে বেশিক্ষণ বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় না বিধায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসারও তেমন সুযোগ পাওয়া যায় না। তাই পশুকে এ রোগ থেকে নিরাপদে রাখতে গলাফুলা রোগের টিকাই সর্বোত্তম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক থেকে শুরু করে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠা সকল খামারে নিয়মমাফিক নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর টিকা দানের মাধ্যমে পশুকে এই দূরারোগ্য সংক্রামক রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারে।
যেকোনো টিকা দেওয়ার পূর্বে কিছু বিধিনিষেধ অনুসরণ করতে হয়, এক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম নয়। গলাফুলা রোগের টিকা বা Haemorrahagic Septicemia Vaccine ১০০ মি.লি. বোতলে তরল অবস্থায় পাওয়া যায় এবং তা ৪ ডিগ্রী থেকে ৮ ডিগ্রী তাপমাত্রায় সংরক্ষিত থাকে। নিম্নে গরুর গলাফুলা রোগের টিকা দেওয়ার নিয়ম সম্পর্কে উপস্থাপন করা হলো:
- টিকা অবশ্যই সুস্থ পশুকে দিতে হয়। অসুস্থ পশুকে টিকা দিলে এর কোনো কার্যকারিতা থাকে না।
- টিকা দানের পূর্বে অবশ্যই টিকার মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ দেখে নিতে হবে। মেয়াদ উত্তীর্ণ টিকাদানের ফলে পশুর মৃত্যুও হতে পারে।
- টিকা উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছানো পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে তা সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষিত ছিল কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে।
- টিকা ইনজেক্ট করার পূর্বে অবশ্যই তা ভালোভাবে ঝাঁকিয়ে নিতে হবে।
- যেকোনা ভ্যাকসিন সাধারণত ভোরে দেওয়াই উত্তম। কোনো কারণে ভোরে দেওয়া অসম্ভব হলে অবশ্যই ছায়াযুক্ত স্থানে ভ্যাকসিন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে।
- পশুর ০৬ মাস বয়সে প্রথম ডোজের টিকা দিতে হয়।
- প্রথম ডোজের পর প্রতি ০৬ মাস অন্তর অন্তর এ টিকা দিতে হয়।
- গলাফুলা রোগের টিকা পশুর ঘাড়ের চামড়ার নিচে দিতে হয়।
- টিকাদানের সময় অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে যেন কোন অবস্থাতেই মাংস পেশীতে টিকা না ঢুকে যায়।
- গরু, মহিষ ও ঘোড়ার ক্ষেত্রে প্রতি ডোজে এ টিকার মাত্রা ২ মিলি।
- ছাগল ও ভেড়ার ক্ষেত্রে প্রতি ডোজে এ টিকার মাত্রা ১ মিলি।
- যখন টিকাদান কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে তখন একসাথে সকল পশুকে টিকার আওতায় আনতে হবে।
- টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য যেকোন একটি পশুকে টিকা দিয়ে ১৫-২০ মিনিট পর্যবেক্ষণ করে নিলে ঝুঁকিমুক্ত থাকা যায়।
- টিকার বোতলে সরাসরি সূর্যালোক লাগা যাবে না।
- টিকার বোতল খোলার ২ ঘণ্টার মধ্যে সমুদয় ওষুধ শেষ করা উত্তম।
- অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং ৪ মাসের নিচে কোনা পশুক এ টিকা না দেওয়াই উত্তম।
লেখকের মন্তব্য
পশু পালন ও খামার ব্যবস্থাপনার প্রধান প্রতিবন্ধক হচ্ছে বিভিন্ন রো্গব্যধি। গবাদি পশুর গলাফুলা রোগ এক প্রকার সংক্রামক রোগ এবং তা খুব দ্রুত মহামারি আকার ধারণ করে ফেলে। গবাদিপশুর রোগব্যধিগুলো তীব্র আকার ধারণ করার পূর্বেই যদি প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় তাহলে এসব প্রতিবন্ধকতা কিছুটা দূর করা সম্ভব হলেও গরুর গলাফুলা রোগের লক্ষণ দেখে চিকিৎসা করার চেয়ে সময়মতো পশুকে ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনাই উত্তম।
গবাদিপশুর জন্য অন্যতম আতঙ্ক গলাফুলা রোগ বিষয়ক নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের সংকলনে রচিত এই আর্টিকেলটি সকল পর্যায়ের খামারীদের জন্য সহায়ক হবে বলে আমার বিশ্বাস। আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হলে অন্যান্য খামারীদের সাথে তথ্যগুলো শেয়ার করার অনুরোধ রইলো। সেই সাথে আর্টিকেলটিতে কোনো প্রকার ভুলত্রুটি সংশোধনের প্রয়োজন হলে কিংবা নতুন কোনো তথ্য সংযোজনের সুযোগ থাকলে কমেন্ট বক্সে আপনাদের সুচিন্তিত মতামত সাদরে গ্রহণযোগ্য।
তথ্যসূত্র: উকিপিডিয়া, agrilife24.com, agricare24.com, poultrydoctorsbd.com, এগ্রোবাংলা, ড. মাহবুব মোস্তফা রচিত আধুনিক পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণ ও চিকিৎসা এবং দুগ্ধবতী গাভী পালন, ড. মো. জালাল উদ্দিন সরদার, অধ্যাপক, এনিমেল হাজবেন্ড্রী এণ্ড ভেটেরিনারি সায়েন্স বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী কর্তৃক রচিত এবং নূর পাবলিকেশন্স, বাংলাবাজার, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত “লাভজনক পশু পালন ও খামার ব্যবস্থাপনা” ও “গৃহপালিত পশু-পাখির রোগব্যাধি ও আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি” বই । খামার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান অর্জন করতে বই তিনটি আপনার সংরক্ষণে রাখতে পারেন। |
আপনার সুচিন্তিত মতামত দিয়ে MrDorpon কে আরও সমৃদ্ধ করতে সহযোগিতা করুন। আপনার মতামতটি রিভিউর পর Published করা হবে।
comment url