আকন্দ গাছের ব্যবহার এবং আকন্দ গাছের বৈশিষ্ট্য ও ছবি
আকন্দ গাছের ব্যবহার এবং গাছটির ঔষধি গুন জানতে গাছে বিদ্যমান বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান সম্পর্কে জানা জরুরী। সেই সাথে গাছটি চেনার জন্য এবং খুঁজে পাওয়ার সুবিধার্থে আকন্দ গাছের বৈশিষ্ট্য জানাও জরুরী।
অতি প্রাচীণকাল থেকে আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসায় আকন্দ গাছের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞরা ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক উপাদান সম্বলিত এই গাছের দুটি জাত নির্ণয় করেছেন। উভয়ের মধ্যেই প্রচুর ঔষধিগুনে ভরপুর।
ভূমিকা
আকন্দ গুল্ম জাতীয় ভেষজ উদ্ভিদ। একসময় গাছটি দেশের আনাচে-কানাচে, গ্রামের রাস্তার ধারে কিংবা রেললাইনের ধারে কিংবা যেকোনো শুষ্ক পতিত জমিতে উপেক্ষিত অবস্থায় দেখা গেলেও বর্তমানে গাছটি প্রায় দুর্লভের দ্বারপ্রান্তে। তবে সম্প্রতি দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে ঔষধি গাছের নার্সারিতে চাষের উদ্যোগ নিয়েছে অনেক উদ্যোক্তারা।
আকন্দ গাছের বৈজ্ঞানিক নাম, ইংরেজি নাম এবং আঞ্চলিক নামসহ গাছটির বৈশিষ্ট্য, গাছে বিদ্যমান রাসায়নিক উপাদান, গাছটির উপকারিতা, আকন্দ গাছের ব্যবহার ও ব্যবহারর্য অংশ এবং কোন অংশ কিভাবে ব্যবহার করতে হয় কিংবা আকন্দ গাছ ব্যবহারের নিয়ম সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এই আর্টিকেলে।
আকন্দ গাছের বৈজ্ঞানিক নাম
আকন্দ গাছ দুই প্রজাতির- লাল আকন্দ (বড় আকন্দ) ও শ্বেত আকন্দ (ছোট আকন্দ)। লাল আকন্দ ঔষধি গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Calotropis gigantea এবং শ্বেত আকন্দ গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Calotropis procera এবং এটি Asclepiadaceae গোত্রের একটি উদ্ভিদ। এর ইংরেজি নাম Mandarin Orange Tree; অঞ্চলভেদে এর আরও কিছু না আছে যেমন- অর্ক, আক, আকওয়ানস, মাদার ইত্যাদি।
আকন্দ গাছের বৈশিষ্ট্য ও ছবি
নিচের ছকে আকন্দ গাছের ছবি ও বৈশিষ্ট্য বা চেনার উপায় উপস্থাপন করা হলো:
আকন্দ গাছের ছবি | আকন্দ গাছের বৈশিষ্ট্য | |
|
লাল আকন্দ (বড় আকন্দ): লম্বা গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। এটি ২.৪ মিটার থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত উচ্চ হয়। এর বাকল হলুদাভ সাদা, শাখাগুলো শক্ত, বিশেষ করে নবীন অংশে সূক্ষ্ম তুলার মতো পিউবিসেন্স আছে। সাদা, দুগ্ধবৎ তরুক্ষীর আছে। পাতা অভিমুখ, উপবৃত্তাকার-আয়তাকার, সূক্ষ্মাগ্র, পুরু। ফুল বেগুনি অথবা সাদা, আম্বেলেট পার্শ্বীয় সাইমে অবস্থিত। ফল ফলিকল, ৯-১০ সেন্টিমিটার লম্বা, চওড়া, পুরু, মাংসল ও সবুজ বর্ণের হয়। বীজ অসংখ্য, ডিম্বাকার ও ধূসর রঙের হয়ে থাকে। |
|
শ্বেত আকন্দ বা ছোট আকন্দ গাছ
|
শ্বেত আকন্দ (ছোট আকন্দ): এটি তুলনামূলক লাল আকন্দ থেকে ছোট খাড়া গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। এর উচ্চতা সাধারণত ১.৮ থেকে ২.৪ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। বাকল নরম স্পঞ্জের মতো। পাতা প্রায়-অবৃন্তক, আয়তাকার অথবা উপবৃত্তাকার অথবা গোলাকার এবং কচি অবস্থায় তুলার মতো পিউবিসেন্ট আছে। এর ফুল সাদা এবং বেশ ছোট। ফল ফলিকল, প্রায় গোলাকার অথবা উপবৃত্তাকার। বীজ ডিম্বাকার ও হাল্কা ধূসর রঙের। |
লাল আকন্দ (বড় আকন্দ) গাছে বিদ্যমান রাসায়নিক উপাদান
পাতা ও কান্ডের প্রধান উপাদান দুগ্ধবৎ তরুক্ষীর, যাতে আছে প্রোটিয়েজ এনজাইম, ক্যালোট্রোপেইন এফ ১, ক্যালোট্রোপেইন এফ ২, ক্যালোট্রোপিন ডি ১ ও ডি ২ এবং গ্লুটাথায়োন, অ্যাসকরবিক অ্যাসিড, ক্যালোটক্সিন, ক্যালাকটিন এবং কাউটোহক।
কাণ্ড ও মূলের বাকলে আছে আলফা এবং বিটা-ক্যালোট্রোপিয়ল, অ্যামাইরিন, টারাজেরল, সিটোস্টেরল, ট্রাইটার্পিন এবং অন্যান্য গ্লাইকোসাইড। পাতায় আছে গ্লাইকোলিপিড, ফসফোলিপিড, মোম এবং ফ্যাটি অ্যাসিড। মূলে থাকে ক্যালোট্রোপিন, উপারিন এবং ক্যালোটক্সিনসহ বিভিন্ন প্রকার কার্ডিয়াক গ্লাইকোসাইড।
শ্বেত আকন্দ (ছোট আকন্দ) গাছে বিদ্যমান রাসায়নিক উপাদান
এই উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশে থাকে কার্ডেনোলাইড, গ্লাইকোসাইডস, ক্যালোট্রোপিন, ক্যালোটক্সিন, উসারিন ও উসারিডিন এবং কোলাইন। মূলের বাকলে আছে বেঞ্জোয়াইল লাইনিওলোন এবং বেঞ্জোয়াইল আইসোলিনিওলোন। মূল, কাণ্ড ও পাতায় আছে উপক্ষার ও বিটা-অ্যামিরিন।
ফুলে আছে সায়ানাডিন-৩-র্যামনোগ্লুকোসাইড। কার্ডিনোলাইড, উসারিন, স্টেরল এবং পেন্টাসাইক্লিক ট্রাইটার্পিন, লিউপিয়ল এবং ক্যালোট্রোপেনাইলও পাতা ও তরুক্ষীরে থাকে। তরুক্ষীরে আরো আছে অ্যাগ্লাইকোন, ক্যালোট্রোপাজেনিন সহ পাঁচটি কার্ডিয়াক স্টেরয়েড গ্লুকোসাইডস।
আকন্দ গাছের ব্যবহার্য অংশ
চমকপ্রদ এই ঔষধি গাছটির প্রায় সব অংশই ব্যবহার যোগ্য। বিশেষ করে গাছটির ফুল, পাতা, শিকড় ও আঠা আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসায় হাজার বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
বড় আকন্দ / লাল আকন্দ গাছের ব্যবহার
- মূল ও পাতার নির্যায়স পেটের টিউমার, ক্যান্সার, ফোঁড়া, সিফিলিস, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, চর্মরোগ, অর্শ, বাত এবং বিষাক্ত পোকা ও সাপের দংশনের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
- মুলের বাকল আমাশয়ে ব্যবহার করা হয়। এটি বিরেচক ও বমি উদ্রেককারী। গোঁদ রোগে মূলের পেস্ট প্রয়োগ করা হয়।
- গাছটির ফুল ক্ষুধাবর্ধক এবং বলকারক। ফুলের চূর্ণ সর্দি, কাশি, হাঁপানি এবং ক্ষুধামন্দায় যথেষ্ট উপকারী।
- বাত, ড্রপসি এবং ঠাণ্ডা লেগে বুকের ব্যাথার চিকিৎসায় গরম পাতার প্রলেপ দেয়া হয়। পাতার নির্যাসের ব্যাকটেরিয়া বিধ্বংসী ক্ষমতা আছে।
ছোট আকন্দ / শ্বেত আকন্দ গাছের ব্যবহার
- বদহজম, পেটফাঁপা, কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্ষুধামন্দা এবং অজিনের চিকিৎসায় মূলের বাকল ব্যবহার করা হয়।
- মূল ও পাতার নির্যাস শ্বসনকে উদ্দীপিত করে এবং রক্তচাপ কমায়।
- হাঁপানির চিকিৎসায় ফুল বেশ কার্যকর।
আকন্দ গাছের ঔষধি গুন / আকন্দ গাছ ব্যবহারের নিয়ম
- অ্যাসিডিটি নিরাময়ে আকন্দ গাছ পুড়িয়ে ০.৬৫ গ্রাম পরিমাণ ছাই পানির সাথে মিশিয়ে পান করলে সঙ্গে সঙ্গে উপকার পাওয়া যায়।
- পেট কামড়ালে বা পেট জ্বালা করলে আকন্দ পাতার সোজা দিকে সরিষার তেল মাখিয়ে পাতাটি অল্প গরম করে পেটের উপর রাখলে বা সেঁক দিলে পেট কামড়ানো বা পেট জ্বালা বন্ধ হয়ে যায়।
- মেয়েদের ঋতুস্রাবজনিত ব্যাথায় আকন্দপাতার সোজা দিকে সরিষার তেল মেখে অল্প গরম করে তলপেটে সেঁক দিলে খুব দ্রুত ব্যথা বন্ধ হয়ে যায়।
- এডিমা বা ড্রপসি কিংবা হাত-পা ফোলা রোগে আকন্দ বেশ উপকারি। ফোলা স্থানে আকন্দ পাতা বেঁধে রাখলে দ্রুত উপকার হয়।
- প্লীহা বা পিলে বড় হয়ে গেলে আকন্দ গাছ পুড়িয়ে ০.৬৫ গ্রাম ছাই দইয়ের সাথে মিশিয়ে নিয়মিত খেলে ধীরে ধীরে প্লীহা সংকুচিত হয় এবং রোগ ভালো হয়।
- শ্বাসকষ্টে আকন্দ শিকড়ের বাকল প্রথমে গুঁড়া করে তারপর আকন্দের আঠায় ভিজিয়ে পুনরায় শুঁকাতে হবে। এরপর তা চুরুট বানিয়ে ধুমপান করলে শ্বাসকষ্ট ভালো হয়।
- নিউমোনিয়াজনিত বেদনায় আকন্দ পাতার সোজা দিকে ঘি মেখে ব্যথার জায়গায় বসিয়ে লবনের পুঁটলি দিয়ে সেঁক দিলে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়।
- কানে কট কট কিংবা শো শো শব্দের চিকিৎসায় আকন্দ পাতা ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে পাতায় পুরানো খাঁটি ঘি মেখে মৃদু আগুনে সেকঁ দিয়ে রস বের করতে হবে। উক্ত গরম রস (সহ্য ক্ষমতা অনুযায়ী) কানের মধ্যে দিয়ে কান তুলা দ্বারা কিছুক্ষণ বন্ধ করে রাখলে খুব দ্রুত কানের এই রোগ নিরাময় করা যায়।
- হজম শক্তি কমে গেলে এবং ক্ষুধামন্দা দেখা দিলে ২ গ্রাম পরিমাণ শুকনো আকন্দ মূল গুঁড়া করে খেলে ক্ষুধা বৃদ্ধি পায়।
লেখকের মন্তব্য
গ্রামে গঞ্জে যত্রতত্র বেড়ে উঠা আকন্দ গাছ হাজার বছর ধরে আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসায় ব্যবহৃত হলেও শুধুমাত্র অজ্ঞতার কারণে অনেকেই গাছটির সুফল ভোগ করতে পারে না। এরই প্রয়াশ থেকে আকন্দ গাছের ব্যবহার এবং চেনার সুবিধার্থে আকন্দ গাছের বৈশিষ্ট্য এবং ছবি সংযোজিত হয়েছে এই আর্টিকেলে।
আশাকরি, প্রকৃতি নির্ভর আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসায় বিশ্বাসী পাঠকগণ আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবেন। সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য উৎস হতে সংকলিত এসব তথ্যে কোনো প্রকার ভুলত্রুটি পরিলক্ষিত হলে কিংবা কোনো সংযোজন বা বিয়োজনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলে কমেন্ট বক্সে আপনার সুচিন্তিত মতামত পেশ করুন।
আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হলে অন্যান্যদের সাথে শেয়ার করার জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ রইলো। সেই সাথে প্রয়োজনের সময় খুব সহজে খুঁজে পেতে আর্টিকেলের লিংক বা আর্টিকেলের ক্যাটাগরি লিংকা কিংবা আমাদের ওয়েবসাইট আপনার ডিভাইসের ব্রাউজারে বুকমার্ক করে রাখতে পারেন।
তথ্যসূত্র: গ্রন্থসমূহ: প্রফেসর ড. নিশীথ কুমার পাল রচিত ভেষজ উদ্ভিদের কথা, আধুনিক আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসা ও ভেষজ উদ্ভিদ, ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ রচিত গাছগাছড়ায় রোগ মুক্তি।ওয়েবসাইটসমূহ: উকিপিডিয়া, দৈনিক ইত্তেফাক। |
আপনার সুচিন্তিত মতামত দিয়ে MrDorpon কে আরও সমৃদ্ধ করতে সহযোগিতা করুন। আপনার মতামতটি রিভিউর পর Published করা হবে।
comment url