কণ্ঠনালী সমস্যার ০৮টি কারণ এবং কণ্ঠ সুন্দর করার উপায়
কণ্ঠনালী সমস্যার ০৮টি কারণ জেনে কণ্ঠস্বরের সঠিক যত্ন ও পরিচর্যার মাধ্যমে আপনিও হতে পারেন কোকিল কণ্ঠী। অন্যথায় গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গের অতিরিক্ত অবহেলা ও অযত্নের কারণে হতে পারে বাকশক্তি হারানোসহ এর চিরস্থায়ী নিস্ক্রিয়তা। যার কণ্ঠ যত সুন্দর তার বাচনভঙ্গি তত চমৎকার। তাই কিভাবে কণ্ঠ সুন্দর করা যায় কিংবা কণ্ঠ সুস্থ রাখার উপায় জেনে কণ্ঠনালীর যত্ন নেওয়া খুবই জরুরী।
মানবদেহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গটির সুস্বাস্থ্য ও সক্রিয়তা নিশ্চিত করতে এবং গান, বক্তব্য, উপস্থাপনা কিংবা ভয়েজ আর্টিস্টদের অন্যতম নিয়ামক কণ্ঠ সুন্দর রাখতে নিয়মিত কণ্ঠনালীর পরিচর্যা করা স্বাস্থ্যসচেতন সকলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ভূমিকা
গলার অভ্যন্তরে ল্যারিংস বা শব্দযন্ত্রে দু’টি ভোকাল কর্ড থাকে। ফুসফুস থেকে নিঃসৃত বাতাসের মাধ্যমে ভোকাল কর্ডে কম্পনের সৃষ্টি করে এবং উক্ত কম্পন থেকেই শব্দের সৃষ্টি হয়। কথা বলা, গান গাওয়া, বক্তব্য কিংবা উপস্থাপনার সময় উক্ত কম্পনের পরিমাণ প্রতি সেকেন্ডে ১০০ থেকে ১০০০ বার হয়ে থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা প্রতিয়মান, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দিনে এক মিলিয়ন বার ভোকাল কর্ড দু’টির সংস্পর্শ হয়।
মানুষের মনের ভাব প্রকাশের প্রধান ও অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে বাগ্যন্ত্র বা কণ্ঠনালী। মনের ভাব প্রকাশে সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গটির সঠিক পরিচর্যা খুবই জরুরী। বিশেষজ্ঞদেরে মতে, সাধারণত কণ্ঠনালী সমস্যার ০৮টি কারণ পরিলক্ষিত হয়েছে এদের মধ্যে বেশিরভাগই সঠিক পরিচর্যা এবং চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় যোগ্য। এছাড়াও বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপায় অবলম্বন করে কণ্ঠ সুন্দর ও সুস্থ রাখা যায়।
কিভাবে কণ্ঠ সুন্দর করা যায়
বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে কণ্ঠ সুন্দর করা যায়। কণ্ঠ সুন্দর করারে উত্তম পন্থা হলো স্বরের ব্যায়াম যাকে সংগীতের ভাষায় রেওয়াজ বলা হয়ে থাকে। সাধারণত কণ্ঠশিল্পীদের জন্য কণ্ঠনালীর এই ব্যায়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কণ্ঠ সুন্দর রাখতে অনেকের মধ্যে বেশ কিছু উপকরণের ব্যবহারও পরিলক্ষিত হয়।
বক্তব্যে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্যও রয়েছে কিছু ব্যায়ম ও নির্দেশনা। এছাড়া উপস্থাপনায় ধ্বনির সঠিক উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গিও কণ্ঠস্বরেরই একটি অংশ। কিভাবে কণ্ঠ সুন্দর করা যায় তার বেশ কিছু পদ্ধতি নিচে উপস্থাপন করা হলো।
রেওয়াজের মাধ্যমে কণ্ঠ সুন্দর করা উপায়
সাধারণত নিম্নোক্ত ০৪টি অনুশীলনের মাধ্যমে সঙ্গীতশিল্পীরা তাদের কণ্ঠ সুন্দর করার চর্চায় নিয়মিত লিপ্ত থাকেন।
- মোটা কণ্ঠস্বর চিকন করতে ‘হং’ ধ্বনির রেওয়াজ খুবই কার্যকরী ও পরীক্ষিত পদ্ধতি । এক্ষেত্রে নাক দিয়ে লম্বা একটি শ্বাস টেনে ধরে ‘হং....’ ধ্বনি উচ্চারিত অবস্থায় মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়তে হবে। সঙ্গীত বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রত্যহ অক্সিজেনযুক্ত মনোরোম পরিবেশে ও সঠিক নিয়ম মেনে মাত্র ৫ মিনিট করে এই রেওয়াজ করলে ১৫ দিনের মধ্যেই এর সুফল পেতে থাকবেন।
- চিকন কণ্ঠ মোটা করার জন্য সঙ্গীত বিশেষজ্ঞরা খুবই সহজ এবং চমৎকার একটি পদ্ধতির কথা বলেছেন। এই পদ্ধতিটি মনের অজান্তেই আমরা হরহামেশা করে থাকি। তাদের মতে, গুনগুন করে গান গাওয়াটাও চিকন কণ্ঠ মোটা করার একটি পদ্ধতি। এক্ষেত্রে প্রতিদিন ৭-১০ মিনিট গুনগুন করে গান করা কিংবা মুখ বন্ধ রেখে গুনগুন করে সুর তোলাও চিকন কণ্ঠ মোটা ও শ্রুতিমধুর করার অন্যতম উপায়।
- কিছু যোগব্যায়ামও আছে যা কণ্ঠকে শ্রুতিমধুর করে তুলে। অক্সিজেনযুক্ত ও কোলাহলমুক্ত পরিবেশে হাটুঘেড়ে বসে দুই হাটুর উপর দুই হাত রেখে নাক দিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মুখ দিয়ে ‘আ....’ আওয়াজ করতঃ ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়তে হবে। এভাবে প্রত্যহ ৮-১০ মিনিট করলে আপনি নিজেই নিজের কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন বুঝতে পারবেন।
- সঙ্গীতের মূলমন্ত্র সা-রে-গা-মা-পা এর চর্চার মাধ্যমেও কণ্ঠ শ্রুতিমধুর হয়ে উঠে। সা-রে-গা-মা-পা মন্ত্রটি খালি গলায় একবার উচ্চস্বর থেকে ক্রমান্বয়ে নিচুস্বরে এবং আরেকবার নিচুস্বর থেকে ক্রমান্বয়ে উচ্চস্বরে নিয়ম মেনে প্রতিদিন ১০ মিনিট করে চর্চা করলে কণ্ঠ সুন্দর ও শ্রুতিমধুর হয়ে উঠবে।
ঔষধি উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে কণ্ঠ সুন্দর করার উপায়
সকলের জন্যই এই পদ্ধতিটি কার্যকর। তবে বক্তব্য দানের ফলে যেন গলা ভেঙ্গে না যায় সেজন্য বক্তাদের মধ্যে এই পদ্ধতিটির ব্যবহার বেশি পরিলক্ষিত হয়। ঔষধি উপকরণ ব্যবহার করে কণ্ঠ সুন্দর করার দুটি উপায় নিচে উপস্থাপন করা হলো:
- এই পদ্ধতিতে বহুল ব্যবহৃত মসলা দারুচিনি খুবই কার্যকরী। এক্ষেত্রে ০১ গ্রাম দারুচিনি গুড়া এক গ্লাস কুসুম গরম পানির সাথে আগের দিন রাতে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন সকালে ছেঁকে পান করতে হবে। এভাবে প্রতিদিন ০১ বার করে টানা ১৫ দিন পান করলে কণ্ঠস্বর হবে বলিষ্ঠ যা আপনি নিজেই উপলব্ধি করতে পারবেন। অথবা, একটুকরো দারুচিনিকে তিন ভাগে বিভক্ত করে দিনে তিনবার চিবিয়ে রস খেলেও ভালো উপকার পাওয়া যায়।
- বচ, কাবাব চিনি, লবঙ্গ, জৈষ্ঠ্যমধু ও তাল মিছরির মিশ্রণ কণ্ঠ সুন্দর ও বলিষ্ঠ করতে খুবই কার্যকরী। এক্ষেত্রে বচ চূর্ণ, জৈষ্ঠ্যমধু চূর্ণ, কাবাব চিনি চূর্ণ ও লবঙ্গ চূর্ণ ৪:৪:২:১ অনুপাতে একত্রিত করে উক্ত মিশ্রণের সাথে পরিমাণমত তাল মিছরি মিশিয়ে হাইজেনিক কাঁচের জারে সংরক্ষণ করুন। পরবর্তীতে যেকোনো বক্তব্যে যাওয়ার সময় অল্প পরিমাণে ছোট কৌটায় করে সাথে নিয়ে যাবেন।
- বক্তব্য শুরুর ১০-১৫ মিনিট পূর্বে উপকরণটি অল্প অল্প করে চুষে খেয়ে টানা ২-৩ ঘণ্টা বক্তব্য দিলেও গলার স্বরের কোনো পরিবর্তন হবে না ইনশাআল্লাহ। সাধারণত ওয়াজ-মাহফিলে বক্তব্যদানকারী বক্তারা এই উপকরণটি বেশ ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়াও জৈষ্ঠ্যমধু বা বচ খালি চিবিয়ে খেলেও কণ্ঠস্বরের অনেক উন্নতি ঘটে।
ধ্বনির সঠিক উচ্চারণের মাধ্যমে কণ্ঠ সুন্দর করার উপায়
কণ্ঠ সুন্দর, শ্রুতিমধুর ও উচ্চারিত শব্দ অন্যের নিকট আকর্ষণীয় করে তুলতে ধ্বনির সঠিক উচ্চার ও শব্দ চয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করতে পারেন:
- অল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণ ধ্বনির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে নির্ভুল শব্দের উচ্চারণ নিশ্চিত করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ- ‘ঘ’ এর উচ্চার যেন ‘গ’ এর মত না হয় কিংবা ‘ঝ’ এর উচ্চারণ যেন ‘ঝ’ এর মতই হয় সেটা যেন কোনোভাবেই ‘জ’ এর মত না হয়। এমন আরও মহাপ্রাণ ধ্বনি আছে যেগুলোর উচ্চারণ সঠিকভাবে না হওয়ার কারণে আমাদের কথা বলার ধরণ অন্যের নিকট শ্রুতিমধুর কিংবা আকর্ষণীয় হয়ে উঠে না।
- অনেকের কণ্ঠে কিছু কিছু শব্দ উচ্চারণের সময় বাঁধার সম্মুখীন হয় কিংবা সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারে না। বক্তব্য কিংবা উপস্থাপনায় সেসব শব্দগুলো ব্যবহারের পূর্বে প্রচুর অনুশীলন করে আত্মস্থ করতে হবে। একান্তই সম্ভব না হলে বিকল্প শব্দ চয়নের মাধ্যমে বক্তব্য সম্পন্ন করতে হবে।
- বক্তব্য বা উপস্থাপনায় বিরাম চিহ্নের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ কথা বলার সময় ব্যবহৃত বাক্যে কোথায় কতটুকু বিরতি দিতে হবে সে বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ধারণা রাখতে হবে। অন্যথায় শ্রোতাদের নিকট আপনার বক্তব্য আকর্ষণীয় না হয়ে উল্টো বিরক্তিকর হয়ে উঠবে।
বাচনভঙ্গির মাধ্যমে কথা শ্রুতিমধুর করার উপায়
কথা বলা, বক্তব্য দেওয়া, আবৃত্তি করা কিংবা খবর উপস্থাপনায় বাচনভঙ্গি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, কোনো জ্বালাময়ী বক্তব্যের এক্সপ্রেসন আর সাধারণ বক্তব্যের এক্সপ্রেসন কখনোই এক হতে পারে না। অনুরূপভাবে কোনো বিদ্রোহী কবিতার আবৃত্তি আর কোনো রোমান্টিক কবিতার আবৃত্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন বাচনভঙ্গিতে পাঠ করতে হবে।
এছাড়াও যারা খবর উপস্থাপন করে তারা কোনো মৃত্যুর খবর কিংবা দূর্ঘটনার খবর পাঠের সময় যদি চেহারায় শোকের ছাপ না রাখে তাহলে তা কখনোই শ্রুতিমধুর হবে না। তেমনি কোন সুখের কিংবা বিজয়ের খবর পাঠে অবশ্যই চেহারায় উল্লাস থাকতে হবে। এজন্যই কথা বলার সময় কণ্ঠের পাশাপাশি বাচনভঙ্গি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কণ্ঠ সুন্দর করার নিত্যনৈমত্তিক কাজসমূহ
উপরোক্ত পদ্ধতিগুলোর বাহিরেও কণ্ঠ সুন্দর রাখতে নিচের কাজগুলো অনুসরণ করা খুবই জরুরী:
- প্রতিদিন কমপক্ষে ২-৩ লিটার পানি পান করতে হবে। পানি কণ্ঠনালীর ভোকাল কর্ডকে আর্দ্র রাখে এবং আর্দ্র ভোকাল কর্ড থেকে শুষ্ক ভোকাল কর্ডের কণ্ঠ বেশি শ্রুতি মধুর। এছাড়াও আর্দ্র ভোকাল কর্ড বেশি ব্যবহার যোগ্য।
- বক্তব্য শুরুর আগে প্রচুর অনুশীলন করতে হবে। খেলা শুরু করার আগে যেমন ব্যায়াম বা অনুশীলন করা জরুরী তেমনি এটাও ভোকাল কর্ডের জন্য একটি ব্যায়াম। অনুশীলনের ফলে ভোকাল কর্ড থেকে প্রবাহিত কণ্ঠের মান বক্তব্য কিংবা উপস্থাপনা সুন্দর ও শ্রুতিমধুর হয়।
- বক্তব্য, উপস্থাপনা কিংবা গান গাওয়ার সময় মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস নিলে ভোকাল কর্ড বিশ্রামের সুযোগ পায়। এর ফলেও কণ্ঠ সুন্দর ও শ্রুতিমধুর হয়।
- কণ্ঠনালীর বিশ্রামের প্রয়োজনে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় সম্পূর্ণরূপে সবধরনের কথা বলা বন্ধ রাখা উচিত। এক্ষেত্রে ভোকাল কর্ডের অবসাদ দূর হয় এবং শক্তি সঞ্চার হয়।
- বক্তব্য কিংবা উপস্থাপনায় ইয়ার বাড ব্যবহার করার চেষ্টা করতে হবে। এতে বক্তব্যদানকালে শুধু নিজের কণ্ঠই শুনা যায় এবং প্রয়োজন অনুযায়ী কণ্ঠ বা কথা বলার ধরণ পরিবর্তন করা যায়। আর এজন্যই গান রেকর্ডিয়ের সময় সঙ্গীতশিল্পীদের কানে হেডফোন লাগানো থাকে।
কণ্ঠ সুস্থ রাখার উপায়
সুন্দর কণ্ঠের জন্য সুস্থ কণ্ঠনালী খুবই জরুরী। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের মতামত বিশ্লেষণপূর্বক, নিচে কণ্ঠ সুস্থ রাখার উপায়সমূহ উপস্থাপন করা হলো:
- প্রতিদিন কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস ইষৎ উষ্ণ পানি পান করতে হবে। কোনোভাবেই ঠান্ডা পানি পান করা যাবে না।
- বক্তব্য কিংবা কণ্ঠস্বর অতিমাত্রায় ব্যবহৃত হয় এমনসব প্রোগ্রামের কিছু সময় পূর্বে কমপক্ষে ০১ গ্লাস পানি পান করে নিতে হবে।
- খাওয়ার পর পাকস্থলিতে থাকা পেপসিন ও হাইড্রোক্লোরিক নামক এসিড তার বিপাকীয় কাজ শুরু করে। খাওয়ার পর পর শুয়ে পড়ার ফলে উক্ত এসিড গলায় চলে আসে। যার ফলে গলা জ্বলে এবং কণ্ঠনালী ইনফেকশন হয়ে গলার স্বর ভেঙ্গে যেতে পারে। এজন্য খাওয়ার পরপরই ঘুমাতে যাওয়া উচিত নয়। এক্ষেত্রে ঘুমাতে যাওয়ার কমপক্ষে ২ ঘণ্টা আগে খাওয়া শেষ করা উত্তম।
- আমরা কমবেশি সবাই জানি ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কণ্ঠনালী ক্যান্সারের অন্যতম কারণ হচ্ছে ধুমপান। তাই কণ্ঠনালী সুন্দর ও সুস্থ রাখতে ধুমপানের বদঅভ্যাস পরিহার করতে হবে।
- অতিরিক্ত উচ্চস্বরে কিংবা কণ্ঠস্বরের স্বাভাবিকতা বর্জন করে পরিবর্তিত স্বরে কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। এতে কণ্ঠনালীর ভোকাল কর্ডে প্রচুর চাপ পরে এবং কণ্ঠনালীতে প্রদাহসহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- মোবাইলফোনে কথা বলার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কণ্ঠনালী বা ভোকালকর্ডের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের শরনাপন্ন হওয়া অধিকাংশই অতিরিক্ত মোবাইল ফোনে কথা বলার কারণে উক্ত সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
- ঘুমানোর পূর্বে ক্যাফেইন যুক্ত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে এবং নিরবিচ্ছিন্ন সতেজ ঘুমের চেষ্টা করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘুমের সাথে কণ্ঠ সুস্থ রাখার এক অদ্ভুদ সম্পর্ক রয়েছে।
- মাঝেমাঝে কানে হেডফোন লাগিয়ে কিংবা কোলাহলমুক্ত কোনো পরিবেশে দাঁড়িয়ে নিজের কণ্ঠ নিজেকে শুনতে হবে। কোনো প্রকার পরিবর্তন কিংবা অস্বস্থি অনুভূত হলে নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
গলা ভাঙ্গা দূর করার উপায় (তীব্র কণ্ঠনালীর প্রদাহ)
সাধারণত বক্তা, গায়ক, রেডিও জকি, সংবাদ পাঠক কিংবা ভয়েজ আর্টিস্ট এদের মধ্যে গলা ভাঙ্গার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এর মূল কারণই হলো ভোকাল কর্ডের উপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা কিংবা পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রামের সুযোগ না দেওয়া। এছাড়াও বিভিন্ন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণেও গলার স্বর ভেঙ্গে যেতে পারে। নিচে গলা ভাঙ্গা দূর করার উপায়সমূহ সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো:
- গলার স্বর ভেঙ্গে গেলে সবচেয়ে প্রাচীন ও ঘরোয়া পদ্ধতি হচ্ছে লবণ মিশ্রিত কুসুম গরম পানি দিয়ে গার্গল করা। এক্ষেত্রে সামান্য আদা ও লং সহ পানি গরম করলে এই পদ্ধতির কার্যক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে দিনে ৫-৬ ছয় বার এই পদ্ধতিটি অনুসরণ করতে হবে।
- ভোকাল কর্ডে অতিরিক্ত চাপের ফলে যদি গলার স্বর ভেঙ্গে যায় তাহলে ভোকাল কর্ডকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্রামের সুযোগ দিলে এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। এক্ষেত্রে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা কোনো কথা না বলে থাকার চেষ্টা করতে হবে। একান্তই প্রয়োজন হলে খুবই নিচুস্বরে অল্প শব্দের মাধ্যমে কথা শেষ করতে হবে।
- গলা ভাঙ্গা অবস্থায় সবসময় কুসুম গরম পানি খেতে হবে। এক্ষেত্রে পানির সাথে সামান্য মধু মিশিয়ে নিয়ে বেশ উপকার পাওয়া যায়।
- এছাড়াও জৈষ্ঠ্যমধু কিংবা বচ কিছুক্ষণ পর পর অল্প পরিমাণে মুখে নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে এর রস সেবন করতে হবে। যেহেতু কিছুক্ষণ পর পর খেতে হবে তাই এই উপকরণটি ছোট কোনো কৌটায় নিয়ে নিজের সাথেই রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
- ২-৩ দিন সঠিক নিয়মে উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করার পরও যদি কণ্ঠস্বর ঠিক না হয় তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কণ্ঠনালী সমস্যার ০৮টি কারণ
মানবদেহের অতি গুরুত্বপূর্ণ এই অর্গানটির পরিচর্যায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যদি ঘন ঘন কণ্ঠস্বরের এমন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় এবং তা ২ সপ্তাহ বা তার অধিক সময় স্থায়ী হয় তাহলে নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। বিভিন্ন কারণে কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন বা কণ্ঠনালীর সমস্যা দেখা দিতে পারে। নিচে কণ্ঠনালী সমস্যার ০৮টি কারণ সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো।
ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত কারণে
কণ্ঠনালীতে অতিমাত্রার ব্যাথা কণ্ঠস্বর পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। সাধারণত ভাইরাসজনিত কারণে কণ্ঠনালী ফুলে গিয়ে ব্যাথার সৃষ্টি করে এবং ভোকাল কর্ডে কম্পনে বিঘ্ন ঘটায়। যার ফলে কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন হওয়া কিংবা কণ্ঠস্বর ভেঙ্গে যাওয়ার উপসর্গ দেখা দেয়। প্রচুর পানি পান করা, কণ্ঠনালীর বিশ্রাম এবং উপরোক্ত ঘরোয়া পদ্ধতি অনুসরণ করে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
তবে কখনও কখনও ব্যাকটেরিয়া জনিত সমস্যার কারণেও কণ্ঠনালীতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এক্ষেত্রে কণ্ঠনালীতে ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং ব্যাথার তীব্রতা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কখনও কখনও শ্বাসকষ্টের মত সমস্যাও দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে কালক্ষেপণ না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াই উত্তম।
দীর্ঘমেয়াদি ল্যারিনজাইটিসের কারণে
ল্যারিনজাইটিস মানেও স্বরযন্ত্রের এক ধরনের প্রদাহ। কণ্ঠস্বর কর্কশ হয়ে যাওয়া, জ্বর, কাশি, গলার সম্মুখভাগে ব্যথা অনুভূত হওয়া এবং কোনো কিছু খাওয়া কিংবা এমনি ঢুক গিলতে কষ্ট পাওয়া ল্যারিনজাইটিসের লক্ষণ। এর সাথে কণ্ঠনালী কিছুটা ফুলে যাওয়া এবং কাশির সাথে শ্লেষ্মা নিঃসরণ হওয়াও ল্যারিনজাইটিসের লক্ষণ।
পাকস্থলির অ্যাসিড রিফ্লাক্সের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ল্যারিনজাইটিস হতে পারে। ধুমপায়ীদের এই সমস্যায় বেশি ভোগতে দেখা যায়। এছাড়াও যারা শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানির জন্য ইনহেলার ব্যবহার করে কিংবা যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কম তাদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ল্যারিনজাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
কণ্ঠস্বরের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে
কণ্ঠনালীকে সঠিক ও নিয়মের বাইরে অতিমাত্রায় ব্যবহার করা, অতি উচ্চস্বরে অনেকক্ষণ কথা বলা এবং দীর্ঘসময় ধরে পরিবর্তিত স্বরে কথা বলার ফলে কণ্ঠনালীর উপর অতিমাত্রায় চাপ প্রয়োগে প্রদাহের সৃষ্টি হয়। এটা অনেকটা সামর্থ্যের বাইরে অতিরিক্ত ওজন মাথায় নেওয়ার ফলে সৃষ্ট সমস্যার সমতুল্য। কথা বলার সময় কণ্ঠনালীর সাথে এর আশেপাশে থাকা মাংশপেশীও কাজ করে।
কথা বলার সময় নির্দিষ্ট বিরতিতে ঠিকভাবে শ্বাস না নিলে গলা ও বাগ্যন্ত্রের মাংসপেশী সংকুচিত হয়ে যায়, শ্বাসযন্ত্রের অবসাদ হয়, কথা বলতে কষ্ট হয় যা কণ্ঠস্বর পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। এছাড়াও কণ্ঠস্বরের অতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে ভোকাল কর্ডে পলিপ বা নডিউল সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি কখনও কখনও রক্ষক্ষরণের মত ঘটনাও ঘটতে পারে।
ভোকাল কর্ড অপব্যবহারের কারণে
ভোকাল কর্ডের অপব্যবহার কণ্ঠনালী সমস্যার অন্যতম একটি কারণ। এক্ষেত্রে সমাবেশ কিংবা কনফারেন্সে মাইক ছাড়া অতি উচ্চস্বরে কথা বলা কিংবা ঝগড়া বিবাদ বা বিতর্ক প্রোগ্রামে চিৎকার করে কথা বলার ফলে কণ্ঠনালীর সমস্যা হতে পারে। এছাড়াও দীর্ঘসময় মোবাইল ফোনে কথা বলা কিংবা ঘাড় ও কানের সাথে মোবাইল চেপে ধরে কথা বলার ফলে কণ্ঠনালী তার স্বাভাবি অবস্থান থেকে বিচ্যুতির ফলে কণ্ঠস্বরে নানা সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে।
বিনাইন, পলিপ, নডিউল বা সিস্টের কারণে
দীর্ঘমেয়াদি কণ্ঠনালীর অপব্যবহারের ফলে কণ্ঠনালীর কম্পনের ওপর মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব পড়ে। যা পরবর্তীতে কণ্ঠনালীতে বিনাইন, পলিপ, নডিউল বা সিস্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে নডিউল হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এছাড়া রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, আইনজীবী, অধিক সন্তানের জননী, মসজিদের ইমাম বা ওয়াজের বক্তা কিংবা হকারদের মধ্যে এসব রোগের প্রবণতা দেখা যায়। ভয়েজ থেরাপি এবং অপারেশনের মাধ্যমে এসব রোগ নিরাময়যোগ্য।
কণ্ঠনালীতে রক্তক্ষরণের কারণে
ভোকাল কর্ডে অসংখ্য সূক্ষ্ম রক্তনালী থাকে যা প্রচন্ড জোরে চিকৎকার করার ফলে উক্ত রক্তনালী ছিঁড়ে কণ্ঠনালীতে রক্তজমাট বাঁধতে পারে। কখনও কখনও রক্তক্ষরণ দেখাও যেতে পারে। এ অবস্থায় যতদিন জমাটবাঁধা রক্ত পুরোপুরি না মিলিয়ে যায় ততদিন কথা বলা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রাখতে হবে।
ভোকাল কর্ডের প্যারালাইসিস বা দূর্বলতার কারণে
ভোকাল কর্ড বা ল্যারিংসের নার্ভের দুর্বলতার জন্য কণ্ঠনালীর সমস্যা হতে পারে। মূলত ভাইরাসজনিত কারণে ভোকাল কর্ড বা ল্যারিংসের নার্ভের দূর্বলতা দেখা দেয়। সাধারণত ভোকাল কর্ডের এক দিকের নার্ভ প্যারালাইসিস হতে দেখা যায়। দুই দিকের নার্ভ প্যারালাইসিস হওয়ার ঘটনা খুবই বিরল। ভোকাল কর্ড প্যারালাইসিসের সাথে ফেসফেসে আওয়াজ এবং এর নিঃশ্বাস জড়িত।
সাধারণত কণ্ঠনালীতে ভাইরাসজনিত ইনফেকশন, টিউমার, ক্যান্সার ও থাইরয়েড অপারেশনের কারণে ভোকাল কর্ড প্যারালাইসিস হয়ে থাকে। একদিক প্যারালাইসিস হলে কণ্ঠনালীর সঠিক বিশ্রামের মাধ্যমে তা কয়েক মাসের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। উক্ত প্যারালাইসিস দীর্ঘদিন স্থায়ী হলে চিকিৎসার মাধ্যমে তা নিরাময়যোগ্য।
কণ্ঠনালীর ক্যান্সারের কারণে
কণ্ঠনালীর ক্যান্সার বা গলার ক্যান্সার কণ্ঠস্বর পরিবর্তনের ভয়ঙ্কর রূপ। কণ্ঠস্বর পরিবর্তন হলে এবং তার সুস্থতার হার ১৫ দিনের মধ্যে নিম্নমূখী না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কণ্ঠনালী ক্যান্সারের পরীক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কণ্ঠনালীর ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করে চিকিৎসা করলে তা সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য এবং এর চিকিৎসা আমাদের দেশেই বিদ্যমান।
লেখকের মন্তব্য
বক্তা, গায়ক, উপস্থাপক কিংবা নাট্য অভিনেতাদের মধ্যে কণ্ঠনালীর সমস্যার প্রবণতা বেশি পরিলক্ষিত হয়। আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি, সুন্দর উপস্থাপনা ও সুমধুর গানের অন্যতম হাতিয়ার কণ্ঠনালীর পরিচর্যা বিষয়ক তথ্যগুলো আমলে রেখে চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক প্রয়োজনীয় চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ ও সুন্দর কণ্ঠ নিশ্চিত করতেই আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
আশাকরি আমাদের এই প্রচেষ্টা আপনাদেরকে উপকৃত করবে। কণ্ঠনালী সমস্যার ০৮টি কারণসহ কণ্ঠ সুন্দর ও সুস্থ রাখার উপায় নিয়ে আলোচিত এই আর্টিকেলের প্রতিটি তথ্য বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র হতে সংগৃহিত ও সংকলিত। তবে এতে কোনো তথ্য সংশোধন, সংযোজন কিংবা বিয়োজনের প্রয়োজন হলে কমেন্টবক্সে আপনার সৃজনশীল মতামত সাদরে গ্রহণযোগ্য।
আপনার সুচিন্তিত মতামত দিয়ে MrDorpon কে আরও সমৃদ্ধ করতে সহযোগিতা করুন। আপনার মতামতটি রিভিউর পর Published করা হবে।
comment url