অনন্তমূল এর উপকারিতা এবং অনন্তমূল খেলে কি হয় জানুন
অনন্তমূল এর উপকারিতা কিংবা অনন্তমূল খেলে কি হয় জানতে প্রথমে গাছটির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবগত হয়ে গাছটিকে চিনতে হবে এবং জানতে হবে অনন্তমূলে থাকা বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান সম্পর্কে। লতানো এই গাছটি ঝোঁপঝাড়ে এবং বনজঙ্গলে অন্যগাছের আশ্রয়ে খুব দ্রুত বেড়ে উঠতে পারে।
বহু ঔষধিগুনে ভরপুর অনন্তমূল অতি প্রাচীন কাল থেকে আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসায় অর্শরোগ, হাঁপানি, কাশি, আমাশয়, মেয়েদের অনিয়মিত ঋতুস্রাব, খোসপাচড়াসহ বিভিন্ন ক্ষত নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
ভূমিকা
ভেষজ এই গাছটি একসময় বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে পতিত জমি, রাস্তার ধারে কিংবা বাড়ির আশেপাশের ঝোপঝাড়ে প্রাকৃতিকভাবেই বেড়ে উঠতো। যত্রতত্র বেড়ে উঠা গাছটির ঔষধিগুন সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার ফলে এবং আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন, বনজঙ্গল উজাড়, নগরায়ন ও ক্রমহ্রাসমান পতিত জমির স্বল্পতায় গাছটি প্রায় দুর্লভের দ্বারপ্রান্তে।
তথ্যপ্রযুক্তির বদৌলতে অনন্তমূলের ভেষজগুন সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর থেকে এর চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। চাহিদার কথা বিবেচনা করে সম্প্রতি দেশের বেশকিছু অঞ্চলে ঔষধি গাছের নার্সারিতে এর চাষ হয়ে হচ্ছে। এছাড়াও অনেকে শুধুমাত্র নিজের চাহিদা মিটানোর জন্য বাড়ির আঙিনায়, ছাদবাগানে কিংবা বারান্দায় স্বল্প পরিসরে টবের মধ্যে রোপন করা হচ্ছে।
অনন্তমূলের বৈজ্ঞানিক নাম কি, অনন্তমূল এর উপকারিতা কি, অনন্তমূল এর কাজ কি কিংবা অনন্তমূল এর কোন অংশ কিভাবে ব্যবহার করতে হয় পাঠকদের এসব প্রশ্নের অবসান ঘটাতে এবং ভেষজ এই গাছটি সম্পর্কে সবাইকে অবগত করতে আমার ক্ষুদ্র প্রয়াস থেকে রচিত অনন্তমূল বিষয়ক এই আর্টিকেলটি।
অনন্তমূলের বৈজ্ঞানিক নাম
অনন্তমূল ঔষধি গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Hemidesmus indicus; পূর্বের বৈজ্ঞানিক নাম Periploca indica; এটি Periplocaceae গোত্রের একটি উদ্ভিদ। এর ইংরেজি নাম Indian sarsaparilla; ইউনানী চিকিৎসায় এবং কিছু কিছু অঞ্চলে এই গাছটি ওশবা নামেও পরিচিত।
অনন্তমূল গাছের বৈশিষ্ট্য / অনন্তমূল গাছ চেনার উপায়
নিচের ছকে অনন্তমূল গাছের বৈশিষ্ট ছবিসহ উপস্থাপন করা হলো:
অনন্তমূলে বিদ্যমান রাসায়নিক উপাদান
এ গাছের মূলে থাকে কমারিন ও একটি উদ্বায়ী তেল যা মূলত হাইড্রোঅক্সিমেথোক্সিবেঞ্জাইলডিহাইড দ্বারা গঠিত। এতে আরো আছে কমারিনোলিগনয়েডস, হেমিডেসমিনস ১ ও ২, স্টেরলস, লিউপিয়ল, অ্যামিরিন, ট্রাইটার্পিন, টেট্রাসাইক্লিক ট্রাইটার্পিন অ্যালকোহল, রজন অ্যাসিড, ফ্যাটি অ্যাসিড, ট্যানিন, স্যাপোনিন এবং কিটোন।
এর কান্ডে আছে ট্রাইটার্পিন ল্যাকটোনস, লিউপানোন এবং অ্যাসিটেট ডেরিভেটিভ, লিউপিয়ল, ডিহাইড্রোলিউপিয়ল অ্যাসিটেট, কিটো লিউপেনিওলাইড, হেক্সাডেকানয়িক এসিড। পাতায় আছে তাৎপর্যপূর্ণ পরিমাণে রুটিন।
অনন্তমূল খেলে কি হয় / অনন্তমূল এর কাজ কি
অনন্তমূল খেলে কি হয় বা অন্তমূল এর কাজ সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো:
- অনন্তমূলের নির্যাস রোগমুক্তিতে মূল্যবান বলকারক ওষুধ হিসেবে কাজ করে।
- অনন্তমূল মূত্রবর্ধক ও মূত্রাশয়ের নানা চিকিৎসায় অনন্তমূল বেশ কার্যকরী।
- রক্ত পরিস্কারক হিসেবেও অনন্তমূলের ব্যবহার বহু প্রচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে।
- পুরনো বাতরোগ, সিফিলিস, রক্তস্রাব ও মেয়েদের ঋতুস্রাবজনিত বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় এ মূল ব্যবহার করা হয়।
অনন্তমূল এর উপকারিতা / অনন্তমূল এর ঔষধি গুণ
অনন্তমূল গাছের মূলই প্রধান ব্যবহার্য অংশ। নিচে গাছটির মূলের উপকারিতা উপস্থাপন করা হলো:
- শক্তিবর্ধক: অনন্তমূল দ্রুত শক্তিবর্ধক হিসেবে টনিকের মতো কাজ করে। গাছটির মূল ছেঁচে এর থেকে নিঃসৃত নির্যাস নিয়মিত পান করলে ক্লান্তি দূর হয় এবং দেহের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
- ত্বকের লাবণ্যতা বৃদ্ধি: অনেকের মধ্যে অল্প বয়সেই চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ পড়ে যাওয়া কিংবা ত্বকের লাবণ্যতা হ্রাস পাওয়ার উপসর্গ দেখা যায়। সেক্ষেত্রে ১-২ গ্রাম অনন্তমূল চূর্ণ, দুধ ও সামান্য পরিমাণে মিস্রি একত্রে মিশিয়ে নিয়মিত পান করলে শরীরের বার্ধক্যের ছাপ দূর হবে এবং ত্বকে ফিরে আসবে লাবণ্যতা।
- খোসপাচড়া নিরাময়: খোসপাঁচড়া, ব্রণ প্রভৃতি চর্মরোগ নিরাময়ে পরপর কয়েকদিন অনন্তমূলের মিউসিলেজ বা ক্বাথ সেবন করলে এবং উক্ত ক্বাথ দিয়ে দূষিত স্থান ধুয়ে ফেললে কয়েক দিনের মধ্যেই চর্মরোগ ভালো হয়।
- হাত-পায়ের জ্বালা নিরাময়: হাত-পায়ের জ্বালা নিরাময়ে অনন্তমূল বেশ কার্যকরী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন প্রাকৃতিক ঔষধ। এক্ষেত্রে ৩ গ্রাম পরিমাণ বাঁটা অনন্তমূল পানির সাথে মিশিয়ে নিয়মিত কিছুদিন খেলে হাত-পায়ের জ্বালা বন্ধ হয়ে যায়।
- পাথুরি রোগ: কিডনি কিংবা পিত্তথলিতে সৃষ্ট পাথর থেকেই পাথুরি রোগের উদ্ভব। পাথুরি রোগে গরুর দুধসহ অনন্তমূল বেটে খেলে বেশ উপকার পাওয়া যায়।
- ক্ষত নিরাময়: পঁচা বা পচনজনিত ক্ষত সৃষ্টি হলে অনন্তমূল গরম পানিতে সিদ্ধ করে তার ক্বাথ দিয়ে ক্ষতস্থান পরিস্কার করলে পচনজনিত ক্ষত ভালো হয়।
- ফোঁড়ার চিকিৎসায় অনন্তমূল: অনন্তমূল বেঁটে অল্প মধুসহ প্রলেপ দিলে ফোঁড়া পেকে যায় এবং ফেটে যায়।
- জিহ্বার ক্ষত নিরাময়: জিহ্বায় ক্ষত সৃষ্টি হলে অন্তমূলের পেস্টের সাথে ভেড়ার দুধ মিশিয়ে উক্ত মিশ্রণ চেটে খেলে জিহ্বার ক্ষত ভালো হয়।
- হাঁপানি চিকিৎসায় অনন্তমূল: অতি প্রাচীনকাল থেকে হাঁপানি রোগের জন্য আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসায় অনন্তমূল ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এক গ্লাস পানির সাথে ৩ গ্রাম পরিমাণ অনন্তমূল বাঁটায় সামান্য লবণ মিশিয়ে দৈনিক সকাল-সন্ধ্যায় পরপর কয়েকদিন পান করলে বেশ উপকার পাওয়া যায়।
- শুষ্ক বা খুসখুসে কাশি নিরাময়: শুষ্ক কাশিতে ১-২ গ্রাম পরিমাণ চূর্ণ অনন্তমূল পানির সাথে মিশিয়ে প্রত্যহ্য দুই বার করে নিয়মিত পান করলে শুষ্ক কাশি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
- হজমশক্তি বৃদ্ধি: হজমশক্তি হ্রাস পেলে এবং পরিপাকক্রিয়ায় গোলযোগ দেখা দিলে নিয়মিত কয়েকদিন অনন্তমূলের ক্বাথ খেলে পরিপাকশক্তি বৃদ্ধি পায় এবং ক্ষুধামন্দা লাঘব করে।
- খাবারে অরুচি দূর করা: খাবারে অরুচি দেখা দিলে অনন্তমূলের ক্বাথ মধুসহ খেলে রুচি বৃদ্ধি পায়।
- আমাশয় নিরাময়ে অনন্তমূল: খালিপেটে অনন্তমূল বেঁটে খেলে আমাশয় ভালো হয়।
- মূত্ররোগে অনন্তমূল: অনন্তমূলের ক্বাথ প্রস্রাবের দোষ বা মূত্ররোগে অত্যন্ত উপকারী।
- বাতব্যথা নিরাময়: বাতজনিত ব্যথায় অনন্তমূলের ক্বাথ ব্যথাস্থানে মাখলে এবং নিয়মিত কয়েকদিন খেলে বেশ উপকার পাওয়া যায়।
- মাতৃদুগ্ধ বৃদ্ধিতে অন্তমূল: নারীর স্তনে দুধ কম হলে অনন্তমূলের ক্বাথ খেলে দুধের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
- রক্তস্রাব নিরাময়: মেয়েদের রক্তস্রাব হলে অনন্তমূল মধুসহ বেঁটে নিয়মিত খেলে রক্তস্রাব নিরাময় হয়।
- ঋতুস্রাব জনিত সমস্যায় অনন্তমূল: অনিয়মিত ঋতুস্রাবে অনন্তমূলের ক্বাথ বিশেষ উপকারি।
- ঘামের দুর্ঘন্ধ দূরীকরণে অনন্তমূল: যাদের শরীর অতিরিক্ত ঘামে এবং ঘাম থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায় তারা যদি নিয়মিত গোসলের পূর্বে অনন্তমূলের পেস্টের সাথে খাঁটি ঘি মিশিয়ে শরীরে মাখে তাহলে ঘামের এই অস্বস্তিকর দুর্গন্ধ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
- ইন্দ্রিয় শক্তি বৃদ্ধি: ইন্দ্রিয় শক্তি বা রতিশক্তি হ্রাস পেলে অনন্তমূল মধুসহ খেলে সুফল পাওয়া যায়।
লেখকের মন্তব্য
অনন্তমূল এর উপকারিতা জেনে এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে কোন রোগের জন্য এর ব্যবহার কেমন হওয়া উচিত সেটা জানা অতীব জরুরী। সেই ভাবনা থেকেই নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে বিভিন্ন তথ্যের সংকলনে আর্টিকেলটি রচিত। আশাকরি প্রকৃতিনির্ভর ভেষজ চিকৎসায় বিশ্বাসী পাঠকদের জন্য এই আর্টিকেলটি সহায়ক হবে।
আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হলে আপনার প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করার জন্য অনুরোধ রইলো। সেই সাথে আর্টিকেলটিতে কোনো প্রকার ভুলত্রুটি পরিলক্ষিত হলে কিংবা নতুন কোনো তথ্য সংযোজনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলে পাঠকদের সৃজনশীল মতামত সাদরে গ্রহণযোগ্য। আর্টিকেলটি প্রয়োজনের সময় দ্রুত খুঁজে পেতে আপনার ডিভাইসের ব্রাউজারে বুকমার্ক করে রাখতে পারেন।
তথ্যসূত্র: গ্রন্থসমূহ: প্রফেসর ড. নিশীথ কুমার পাল রচিত ভেষজ উদ্ভিদের কথা, আধুনিক আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসা ও ভেষজ উদ্ভিদ, ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ রচিত গাছগাছড়ায় রোগ মুক্তি। ওয়েবসাইট: উকিপিডিয়া। |
আপনার সুচিন্তিত মতামত দিয়ে MrDorpon কে আরও সমৃদ্ধ করতে সহযোগিতা করুন। আপনার মতামতটি রিভিউর পর Published করা হবে।
comment url